।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ি থেকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্ধকোটি টাকা মূল্যের একটি জেনারেটর ‘গায়েব’ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত জুন মাসে খামারবাড়ির অফিস কক্ষ থেকে জেনারেটরটি ‘গায়েব’ হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, অধিদফতরের সাবেক উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ, ক্যাশিয়ার আব্দুল আজিজসহ কয়েকজন কর্মচারীর যোগসাজশে জেনারেটরটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে জেনারেটর কেনার কাগজপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে কয়েকজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষক পরবর্তী উপ-পরিচালক ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
জেনারেটর গায়েবের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সদ্য লালমনিরহাটে বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ও জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা শামসুদ্দিন মিঞা। তিনি বলেন, ‘ইফাত প্রকল্পের উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটরটি অফিস কক্ষ থেকে গায়েব হয়ে গেছে। জেনারেটরটির কাগজপত্রও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খামারবাড়ির কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা জানান, গত জুন মাসে সাবেক উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ ও ক্যাশিয়ার আব্দুল আজিজের যোগসাজশে অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে জেনারেটরটি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর জেনারেটর কক্ষের সব আলামত ধ্বংস করে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন উপ-পরিচালকের গাড়িচালক জহুরুল হক। এ নিয়ে তদন্ত শুরু হলে আরেকটি ছোট জেনারেটর রেখে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ গত ২৯ জুন অবসরোত্তর (পিআরএল) ছুটিতে যান। অবসরের আগে গত জুন মাসে অফিসের ক্যাশিয়ার আব্দুল আজিজ, স্টোরকিপার মমিনুল ইসলাম ও গাড়িচালক জহুরুল হকসহ কয়েকজন কর্মচারী জেনারেটরটি বিক্রি করেন এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সরিয়ে ফেলেন। আব্দুর রশিদ বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার অবসরের পর এ নিয়ে কয়েকজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পরবর্তী ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শামসুদ্দিন মিঞার কাছে অভিযোগ দেন।
এরপর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে এবং ঝামেলা এড়াতে শামসুদ্দিন মিঞা অতিরিক্ত উপ-পরিচালক খাজানুর রহমান ও অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদকে সঙ্গে নিয়ে অভিযোগকারীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন। বেঠকে জেনারেটর বিক্রির বিষয়টি কোনোভাবেই যেন জানাজানি না হয় সেজন্য অভিযোগকারীদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেন তারা।
কিন্তু বৈঠকে সুরাহা না হওয়ায় বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এরপর কয়েকজন কৃষক উপ-পরিচালক শামসুদ্দিন মিঞার সঙ্গে দেখা করে জেনারেটর বিক্রির ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। সেইসঙ্গে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। গত ৩১ আগস্ট শামসুদ্দিন মিঞা অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. আজিজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
অভিযোগকারী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ‘জেনারেটর বিক্রির ঘটনা নিয়ে দায়সারা তদন্ত করেছে কমিটি। জেনারেটর বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করা হলেও তদন্ত কমিটি জেনারেটর নিয়ে আমাদের কোনও মতামত চায়নি, অনুসন্ধানও করেনি। সাবেক উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ ও ক্যাশিয়ার আব্দুল আজিজের দুর্নীতি ঢাকতে কাজ করেছে তদন্ত কমিটি। জেনারেটর গায়েব হলেও তদন্ত কমিটি গঠনের আগে আরেকটি ছোট জেনারেটর নিয়ে এসে অফিস চত্বরে রাখা হয়। যার মূল্য এক বা দুই লাখ টাকা হতে পারে। কিন্তু ইফাদ প্রকল্পের যে জেনারেটর চুরি করে বিক্রি করা হয়েছে, সেটির মূল্য অর্ধকোটি টাকা ছিল বলে আমরা জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’
অভিযোগকারী স্থানীয় কৃষক রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরে জেনারেটর চুরির বিষয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করলে বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। পরে লিখিত অভিযোগ দিই। কিন্তু অনেকদিন পার হলেও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এভাবে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অধিকার কারও নেই। আমরা আগামীতে আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
খামারবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জেনারেটর রাখার কক্ষে বর্তমান উপ-পরিচালকের গাড়িচালক জহুরুল থাকছেন। ওই কক্ষে যে জেনারেটর বসানো হয়েছিল সে চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। আগের জেনারেটরের বিষয়ে জানতে চাইলে জহুরুল তার রান্নাঘরে রাখা একটি ছোট জেনারেটর দেখান। যার সঙ্গে বিক্রি করে দেওয়া ইফাদ প্রকল্পের জেনারেটরের কোনও মিল নেই।
এ বিষয়ে সাবেক উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘জেনারেটর অফিস কক্ষে আছে। এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে পারবো না।’ আর কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
অভিযুক্ত ক্যাশিয়ার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘জেনারেটর স্টোরকিপারের দায়িত্বে ছিল। আমি অফিস ক্যাম্পাসে থাকতাম। ওই ঘটনায় আমাকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি বর্তমানে লালমনিরহাটে বদলি হয়ে এসেছি। বিষয়টি অফিসের সবাই জানে। আপনি অফিসে গিয়ে কথা বলেন।’
সে সময়ে দায়িত্বে থাকা স্টোরকিপার মমিনুল ইসলাম বর্তমানে নাগেশ্বরীতে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আমি সব ডকুমেন্ট আমার দফতরকে দিয়েছি। আমাকে এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করিয়েন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুদ্দিন মিঞা বলেন, ‘জেনারেটরটি হারিয়ে গেছে এবং তার পরিবর্তে আরেকটি জেনারেটর সেখানে রাখা হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া জেনারেটরটির সঙ্গে পরে রাখা জেনারেটরের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও নথিপত্র না থাকায় প্রমাণ করাও যাচ্ছে না। সেটি হারিয়ে যাওয়া জেনারেটর কিনা তদন্ত কমিটি নির্ণয় করতে পারেনি।’
উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, ‘জেনারেটর গায়েবের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। আগের জেনারেটরটি কী ধরনের ছিল, তার কাগজপত্র না পাওয়ায় বর্তমানে রাখা জেনারেটরটি সেটি কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। বিষয়টি তদন্তাধীন থাকায় কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’