।। নিউজ ডেস্ক ।।
উলিপুরে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলা, দর কষাকষি, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ৩১ কোটি ৭লাখ ২৪হাজার ১৭৬ টাকা ফেরত গেছে। ঘটনাটি জানাজানি হলে সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি(এডিপি) এর আওতায় উপজেলা প্রকৌশলী এডিপি’র দু’টি মেরামত কাজের জন্য দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ১১ মে স্বাক্ষার করে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দেন। নোটিশ নং ০৮/২০২১-২০২২। কাজ দু’টি হলো উপজেলা পরিষদের নতুন ভবন মেরামতের জন্য ১২লাখ টাকা ও উপজেলা পরিষদ হলরুমের নতুন ভবনের মেরামতের বাবদ ১৫ লাখ টাকা। লটারীর মাধ্যমে কাজ দু’টি পান ঠিকাদার মাহে আলম ও অপু টেডার্স। মেরামত কাজ দু’টি লাভজনক হওয়ায় উপজেলা প্রকৌশলী কে কে এম সাদেকুল আলম ঠিকাদারদের অফিসে ডেকে নেন। এরপর তিনি ঠিকাদারদের ৫% লাভ দিয়ে কাজ দু’টি নিতে চাইলে ঠিকাদাররা রাজি হননি বলে জানা গেছে। পরবর্তীতে ঠিকাদাররা কাজ করার জন্য উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে গেলে তিনি মোটা অংকের টাকা দাবী করেন বলে তারা জানান। ঠিকাদাররা উপজেলা প্রকৌশীর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে ২৭ লাখ টাকা ফেরত যায়।
এছাড়া উপজেলা প্রকৗশলী এডিপি’র আওতায় ২১টি প্যাকেজে কাজ বাস্তবায়নের জন্য এলজিইডি’র হালনাগাদ তালিকাভূক্ত (রংপুর অঞ্চল) ঠিকাদার/ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে শর্তসাপেক্ষে সীলমোহরযুক্ত খামে সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে (অফ-লাইন এলটিএম) আহবান করা হয়। নোটিশ নং ০৭/২০২১-২২। দরপত্র সিডিউল বিক্রয়ের শেষ তারিখ ছিল ২৪ এপ্রিল/২২ইং বিকেল সাড়ে ৩টা, গ্রহনের তারিখ ছিল ২৫ এপ্রিল/২২ইং বেলা ১টা এবং ওইদিন উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে খোলার সময় ছিল বিকেল ৩টা। দরপত্র বিজ্ঞপ্তির নিয়মানুযায়ী ১৪ নং প্যাকেজ কেসি রোড থেকে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের গেট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ। যার প্রাক্কলন মূল্য ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮’শ ৪০টাকা। একই প্যাকেজের কেসি রোডের উলিপুর বিজ্ঞান এন্ড টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে তাজুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ। যার প্রাক্কলন মূল্য ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা। প্যাকেজের কাজ দু’টি পান ঠিকাদার হালিমুজ্জামান বাবলু। রাস্তার প্রথমটি এইচবিবিকরণ ও দ্বিতীয়টি পূর্বের পাকাকরণ থাকলেও প্রকৌশলী সংস্কার না দেখিয়ে নতুন করে রাস্তা নির্মাণ কাজ দেখান। উপজেলা প্রকৌশলী নিজে ফায়দা লুটে নেয়ার জন্য করলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা রাজি না হওয়ায় তিনি পরিকল্পিতভাবে বিলটি তৈরি করে অফিসে রেখে দেন। সময় মতো বিলটি উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে জমা না হওয়ায় ৩০ জুন সরকারি সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৮’শ ৪০ টাকা ফেরত যায়।
এদিকে ২০১৮ সালে কুড়িগ্রাম ও জামালপুর জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র হ্রাসকরণ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বগুড়ার বে-সরকারি সংস্থা পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)। প্রকল্পের সুবিধাভোগি নির্বাচন করা হয়েছে বিবিএসের খানা জরিপের মাধ্যমে। কিন্তু শুরুতেই একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি, স্বচ্ছল ও ধনাঢ্য পরিবারের মাঝে গরু বিতরণসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০২০ সালে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা চান তাদের মনোনীত তালিকা অনুযায়ী উপকারভোগি নির্বাচন করতে। বিরোধ ও ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনেও সমঝোতা হয়নি। এ অর্থবছর প্রকল্পের মেয়াদ ২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হলেও, গরু বিতরণ কর্মসূচি বাদ দেয়া হয়। ফলে এ উপজেলায় ৩১৬০ হতদরিদ্র পরিবার ৪০ হাজার টাকা মূল্যের গরু, লালন-পালনের জন্য ওষুধ বাবদ এককালীন ৩৫০ টাকা ও ৬ মাস ৫’শ করে টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এসব কারণে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ফেরত গেছে। প্রকল্প পরিচালক জাহেদুল হক চৌধুরীর সাথে কথা হলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
এছাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিরাজুদৌলার দায়িত্ব অবহেলা, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাইলট প্রকল্প হিসেবে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৫হাজার ৭১ জনের জন্য ১৬ কোটি ৯৯লাখ ৬ হাজার ৩৩৬ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় ১৭ নভেম্বর/২১ইং চিঠি দিয়ে উপকারভোগীদের নামের তালিকা পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেয়। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারী উপজেলা পরিষদে মিটিং করে নামের তালিকা চেয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব ও পরে তিন দফায় নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানদের ইউএনও। ৬টি ইউনয়নের তালিকা সময় মতো জমা দিলেও বাকি ৭টি ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়। ফলে বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত যায়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিরাজুদৌলা বলেন, জনপ্রতিনিধিদের কাছে একাধিবার কাগজ চাওয়া হয়। কিন্তু তারা যথাসময় কাগজ জমা না দেয়ায় কারণে টাকা ফেরত গেছে।
অপু ট্রেডার্স স্বত্ত্বাধিকারি ঠিকাদার অপুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি কাজটি পাওয়ার পর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে বলে কাজ ছেড়ে দেন, আমরা আপনাকে ৫% দিবো। আমি রাজি হইনি, বলছি কাজ বেচবো না, আমি করবো। পরে উনি বলেন, যদি আপনারা কাজ করতে চান তাহলে ১০% টাকা দিতে হবে। কারণ কাজটি নিয়ে আসতে টাকা লাগছে।
এ বিষয়য়ে ঠিকাদার হালিমুজ্জামান বাবলুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার নামে কাজ হলেও আমি করি না। আমার কাছ থেকে উপজেলা প্রকৌশলী কাজ দু’টি নিয়েছে। কে করছে দেখেন।
প্রকল্পের সদস্য সচিব ও উপজেলা প্রকৌশলী কে কে এম সাদেকুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা মিথ্যা। ঠিকাদার বিল জমা না দেয়ায় টাকা ফেরত গেছে। তবে বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।
প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন মন্টু বলেন, ঠিকাদার কাজ না করার কারণে টাকা ফেরত গেছে। তিনি ইজিপিপি’র টাকা ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে দ্বন্দ্বের কথা অস্বিকার করে আরো বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানগণ যথাসময় কাগজ জমা না দেয়ায় কারণে টাকা ফেরত গেছে।
//নিউজ/উলিপুর//মালেক/সেপ্টেম্বর/২৩/২২