।। প্রফেসর মীর্জা মো: নাসির উদ্দিন ।।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খাদ্য ঘাটতির দেশকে কৃষিতে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রথমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) গঠণ করেন যা ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গাজীপুরে স্থানান্তরিত হয় । তাঁর সময়ে ফিলিপাইনের আন্তজার্তিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে আইআর-৮ জাতের উচ্চফলনশীল ধানের ১৬,১২৫ টন মানসম্পন্ন ধান বীজ আমদানি করা হয়। বিদেশ থেকে ৪৫৪ টন পাট বীজ, ১১১ টন উফশী গম বীজ ও ১৭০০ মন উফশী আলু বীজ আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। দানাদার ফসল ও বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য পূর্ব জার্মানি থেকে ৩৮,০০০ সেচযন্ত্র আমদানি করা হয়। ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো – লিফট পাম্প, ২,৯০০টি গভীর নলকূপ ও ৩ হাজারটি অগভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। পাকিস্তানি শাসকদের নির্মম শোষণ-বঞ্চনায় স্বাধীনতার পর মাইনাস ১৪ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের বাস্তব শাসনামলে দেশের কৃষি খাতে সার্বিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৭ শতাংশ। দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ করা হলো বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব। তিনি ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে উপস্থিত ছাত্র/ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু প্রাকটিক্যাল কাজ করতে হবে। কৃষি বিপ্লবের জন্য প্যান্ট- শার্ট -কোট খুলে মাঠে নামতে হবে।দেশ এগোতে থাকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পথে।কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডের সাথে সাথে খাদ্য উৎপাদন সহ সকল ক্ষেত্রে দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরী জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে আবার শুরু হয় অগ্রযাত্রা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা,সাহস ও ঝুকি গ্রহণের দৃঢ় বলিষ্ট নেতৃত্বে আজকে দেশের খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি টন।দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী জনবল তৈরিতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবর্তক। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা দেশের উচ্চশিক্ষাকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই কন্যা শেখ হাসিনা তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসোপানে।জাতির পিতা ১৯৭২ সালে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য যেমনটি ভেবেছিলেন ঠিক তেমনিই দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রামে কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বাস্তব পদক্ষেপ। কৃষিই এ জেলার একমাত্র জীবিকা অর্জনের সহজ পন্থা।শিল্প বলতে এ জেলায় একটি স্পিনিংস মিলস ও কয়েকটি ধানভাঙ্গার রাইস মিল ছাড়া আন কোন কিছুই নেই। কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটলে তা থেকে কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপিত হবে যা পরবর্তীতে অন্য ধরণের ভারী শিল্পের বিস্তারে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে উৎপন্ন সকল ফসল কুড়িগ্রাম জেলায় উৎপন্ন হয়।এ জেলার মোট আবাদ যোগ্য জমির পরিমাণ ৩,৪১,২২৫ হেক্টর, অনাবাদী জমির পরিমাণ ১৯,৩২০ হেক্টর, নদীর সংখ্যা ১৬টি, চর সংখ্যা ৪২০ টিরও বেশি। জমির ভূ-প্রকৃতি – নদীবেষ্ঠিত পলি গঠিত সমতল ভূমি ও চরাঞ্চল। এ জেলার মাটির প্রকৃতি কৃষি উপযোগী-দোয়াশ, বেলে ,এটেল এবং কংকর (শুধুমাত্র রৌমারি উপজেলা) মাটির আয়তন যথাক্রমে ২৩০৫৬২ একর , ৫৬১৬৫ একর ,৫১৬৪৬ একর এবং ১৭,৩২৯ একর । দোয়াশ মাটি অধিক থাকায় কুড়িগ্রাম একটি কৃষি সমৃদ্ধ জেলা।
প্রত্যেকটি ফসল উৎপাদনের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত গবেষণার মাধ্যমে। এ জেলায় ধান-৬৯৮৬১৬ মেট্রিক টন, গম-২০৫৮৮ মেট্রিক টন, ভুট্রা-৬৭৭৬ মে:ট, কাউন-৫০৪ মে.ট, পাট- ৩৪৪০৫ মে.ট, আলু- ৫৯৫৩৭ মে.ট, মিষ্টি আলু- ৫১০৩ মে.ট, আখ- ৫২৭৮ মে.ট, আম-১৩৩৩৭ মে.টি, লিচু-৯৬১১ মে.ট,জাম-২৯৭৮ মে.ট, তরমুজ/বাঙ্গি-২৭২ মে.ট,তুলা-৩২ মে.ট, মসুর-১০৭৫ মে.ট,মুগ-৩০৬ মে.ট,ছোলা-৮৯মে.ট, খেসারি-১২১০মে.ট,মাসকালাই-৮৯মে.ট,সরিষা-৫৬০৭ মে.ট,বাদাম- ১৫২২ মে.ট, তিল-৩০৮ মে.ট,মরিচ-১৫৭৪ মে.ট,পিয়াজ-৩২৯৩ মে.ট,রসুন-৯১১মে,ট,হলুদ-১৭৮৬ মে.ট, আদা-৯১৯ মে,ট,টমেটো-১৩৪ মে.ট,মূলা-৪৬২৭ মে,ট, সীম-৩৬১ মে.ট, মিঠকুমড়া-১৪৯৭ মে.ট, পটল- ৫৯৪ মে.ট ,বাধাকপি-২২৯৭মে,ট, ফুলকপি-১৫৪৩ মে,ট, পেপে-৫৪০৯ ,পেয়ারা-৭৬৪ মে.ট, কাঠাল-৩৩১০ মে.ট, কলা-২৯৭২০ মে.ট, আনারস-৪১৭ মে,ট,বেগুন-৫৪০৯ মে,ট, ঢেড়স-৭৬৪ মে,ট,কচু-৩০২৬ মে,ট, মিঠকুমড়া-৯৩৫ মে,ট, লেবু/ জাম্বুরা-৩০২ মে,ট উৎপন্ন হয় (সূত্র: বিবিএস-২০১৩,পৃ: ২৯-৪৫)। কুড়িগ্রাম গবাদি পশু, ছাগল,ভেড়া , ঘোড়া এবং মৎস্য সম্পদে সম্ভাবনাময়ী একটি জেলা।
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে উৎপন্ন প্রায় প্রত্যেকটি ফসল ও প্রাণী সম্পদ কুড়িগ্রাম জেলায় উৎপন্ন হয় বা আছে । এখন শুধু প্রয়োজন কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মাধ্যমে প্রাণী সম্পদসহ ফসলগুলোর গুণ, মান ও সংখ্যা/পরিমাণ বাড়ানো। এ প্রসংগে নেদারল্যান্ডের ওয়েজেনিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার কিছু ফলাফল উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেখানকার মাত্র ২% লোক কৃষিতে নিয়োজিত কিন্ত তারা ৯০ বিলিয়ন ডলারের কৃষি পণ্য আয় করে কিন্তু বাংলাদেশের ৪৪% লোক কৃষিতে নিয়োজিত থাকার পরও আমরা মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে তাঁরা কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গবেষণা করে সফলতা লাভ করেছে। যেমন-
(১) ফার্ম সাইজ বনাম ইনকাম সাইজ:
কোন কোন ফসল অনেক জমিতে বপন করার পর যদি সেফসলের মূল্য না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে ফার্ম সাইজ বড় হলেও লাভ নেই। আবার সামান্য জমিতে অল্প ফসল লাগালেও যদি তার মূল্য বেশি হয় তাহলে কৃষক লাভবান হয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় এক কৃষক ৫ একর জমিতে ধান লাগিয়ে খরচ বাদে পেল ৬০,০০০ টাকা আবার আর এক কৃষক ০১ একর সুপারি বাগানে খরচ ছাড়াই টাকা পেল ১,৫০,০০০ টাকা। তা হলে ২য় কৃষক অল্প জমিতে অর্থাৎ ছোট ফার্ম সাইজে অধিক লাভবান হয়েছে। অর্থাৎ ফার্মসাইজের তুলনায় ইনকাম সাইজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।সহজভাবে বলা যায় সোনার খনি যত ছোটই হউক তার মূল্য অনেক বেশি আবার কয়লার খনি যত বড় হউক না কেন সোনার তুলনায় তার মূল্য অনেক কম।এ ভাবে প্রত্যেকটি বিষয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে অগ্রসর হলে কৃষক লাভবান হয় এবং দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়।
(২) ল্যান্ড প্রোডাকটিভিটি বনাম লেবার প্রোডাকটিভিটি:
আমাদের গবেষণাগুলো মূলত: জমির উৎপাদন বাড়ানো কেন্দ্রিক অর্থাৎ একরে যদি ৬০ মন ধান পাওয়া যায় তাহলে কিভাবে সেটাকে ৮০ মনে উন্নীত করা যায়। এভাবে ল্যান্ড প্রোডাকটিভিটি বাড়াতে যেয়ে কৃষি ও পরিবেশের বারটা বেজে গেছে। কিন্তু লেবার প্রোডাকটিভিটি হলো যেখানে ৫০ মন ধান উৎপন্ন করতে ১০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন সেখানে কিভাবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ০২ জন শ্রমিক দিয়ে সেই উৎপাদন বহাল রাখা যায়। তাহলে উৎপাদন ব্যয় কমবে এবং উদ্বৃত্ত ম্যানপাওয়ারকে শিল্প বা ম্যানু্ফ্যাকটারিং খাতে স্থানান্তর করা যাবে।
(৩) এক সময় আমাদের কৃষি ছিল বৃষ্টির পানি নির্ভর এখন তা সেচ নির্ভর। সেচ নির্ভর হলেও অন্যান্য ফ্যাক্টর গুলোর জন্য আমরা পুরোপুরি আবহাওয়া নির্ভর। আবহাওয়া নির্ভরতা কাটাতে না পেরে আমাদের কৃষিতে খরচ ও ক্ষতি অনেক বেশি। উন্নত দেশের কৃষি বিশেষ করে হর্টিকালচার এখন আর বৃষ্টি বা আবহাওয়া নির্ভর নয়। তাঁরা গ্রীন হাউস তথা গ্লাস ঘরে সব কিছু উৎপাদন করছে। উন্নত দেশে কৃষি ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরণের ন্যানোটেকনোলজী ব্যবহৃত হচ্ছে।ফলে তাদের ম্যানপাওয়ার ও সার খুবই কম লাগছে। কীটনাশক ও বালাইনাশকের তেমন কোন প্রয়োজন নেই। আর এ সকল কাজের একমাত্র উৎস স্থল গবেষণাধর্মী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
এ সকল বিষয় ছাড়াও কুড়িগ্রামের তাপমাত্রা, আদ্রতা,বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, ভূমিরুপ, ভূমির শ্রেণী, সার বিন্যাস সবকিছুই বিশ্বেষণ করে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা অব্যাহত রাখলে কৃষি জেলা কুড়িগ্রাম হবে বাংলাদেশের একটি অন্যতম ফসল ভান্ডার, ফলভান্ডার এবং সব্জি ভান্ডার,মৎস্য সহ প্রাণী সম্পদের ভরপুর একটি জেলা।
শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ এবং প্রশিক্ষণের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, প্রশিক্ষক, টেকনিশিয়ান এবং সম্প্রসারণ কাজে যুক্ত সবাই যদি বিশ্ববিদ্যালয়টি ধারণ করার মানসিকতা নিয়ে তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেন, তবেই বিশ্ববিদ্যালয়টি সফলতার মুখ দেখবে। সবদিক বিবেচনায় কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি দূরদর্শী চিন্তার ফসল। আশা করি কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই চিন্তাকে বাস্তবে রুপদান করবে। কৃষি জেলা কুড়িগ্রাম কাউকে অনুসরণ না করে সর্বত্র অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, ত্যাগ, দূরদর্শিতা, মেধা, সততা, সাহসিকতা, অতল দেশপ্রেম, বিস্ময়কর প্রাণশক্তির প্রতিফলন ঘটাবে এই কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখকঃ
প্রফেসর মীর্জা মো: নাসির উদ্দিন,
অধ্যক্ষ,
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম।