।। নিউজ ডেস্ক ।।
উলিপুর উপজেলা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তর দিকে ধরণীবাড়ী ইউনিয়নে ৩৯ একর জমির উপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুন্সিবাড়িটি। আঠারো শতকে বিনোদী লালের পালক ছেলে শ্রী ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির তত্ত্বাবধানে চমৎকার স্থাপত্যের এই মুন্সিবাড়ী নির্মিত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, কাশিম বাজার এস্টেটের সপ্তম জমিদার কৃষ্ণনাথ নন্দী একটি খুনের মামলায় আদালতের কক্ষে দাঁড়ানো অসম্মানজনক বিবেচনা করে ৩১ অক্টোবর ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তার বাসভবনে আত্মহত্যা করেছিলেন। জমিদার কৃষ্ণনাথ নন্দীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মহারাণী স্বর্ণময়ী কাশিম বাজার এস্টেটের জমিদার হন। স্বর্ণময়ী একজন শিক্ষিত এবং জমিদারপন্থী ছিলেন। মহারাণী স্বর্ণময়ী দেবীর অধীনে হিসাব রক্ষকের কাজ করতো বিনোদী লাল নামের এক মুনসেফ বা মুন্সি।
কথিত আছে, একদিন বিনোদী লাল মুন্সি হাতির পিঠে চরে শিকার করতে গিয়ে একটি ব্যাঙ সাপ ধরে খাওয়ার দৃশ্য দেখতে পান। আগেকার দিনে মানুষেরা বিশ্বাস করতেন যেস্থানে ব্যাঙ সাপকে ধরে খায় সেই স্থানে বাড়ী করলে অনেক ধন সম্পত্তির মালিক হওয়া যায়। তাই বিনোদী লাল মহারাণী স্বর্ণময়ী কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এই স্থানে একটি বাড়ী নির্মাণ করেন। বাড়ীটি নিয়ে বিভিন্ন গুজব রয়েছে। অনেকে বাড়িটিকে বনোয়ারি মুন্সিবাড়ি বলে থাকেন। এর কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয় যে বনোয়ারি নামে এক কৃষক এই বাড়িতে থাকতেন।
যাই হোক না কেন, ধরণীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের অফিসিয়াল ওয়েবে এটি রাজবাড়ী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। মোঘল আমলের স্থাপনার সাথে বিট্রিশ আদলের সমন্বয়ে বিভিন্ন কারুকার্যের অপরুপ সৌন্দর্য বাড়ী নির্মাণ করা হয়। বাড়ীটি দেখলেই মনে হবে কোন শিল্পীর হাতে আঁকা এক চিলতে ছবি।
সেই আট্রালিকার প্রথম তলায় তিনটি বড় কক্ষ রয়েছে। বাড়িটির একটি কক্ষে রক্ষিত ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির প্রতিকৃতি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ভেবে বাড়িটিতে আক্রমণ করে। আর পাক হানাদার বাহিনী এ কক্ষে রক্ষিত ছবিটি বেয়নেট দিয়ে নষ্ট করে। যা আজও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে দৃশ্যমান।
ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সির স্ত্রী আশালতা মুন্সি দুই কন্যা সন্তান জন্ম দেন। বড় মেয়ে সুচি রাণী (টিটু) আর ছোট মেয়ে সুস্মান কান্তি (বুড়ি) ছিল। সুস্মান কান্তি (বুড়ি) কম বয়সেই মারা যান। টিটু বড় হওয়ার পরে মুন্সি ভাবলেন, আমি ধরণীবাড়ী, বেগমগঞ্জ, মুঘলবাসা, গাইবান্ধা ও মালিবাড়ির বাড়িওয়ালা তবে আমার বাড়ি ভালো না হলে আমি আমার মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে করাতে পারব না।
এই কথা ভেবে যখন দ্বিতল অট্রালিকা তৈরি হয়েছিল, তিনি কলকাতায় তাঁর মেয়েকে দুর্দান্ত আড়ম্বরের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকে অনেক বছর কেটে গেছে। ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তার কোনও ছেলে সন্তান ছিল না।তাঁর স্ত্রী আশালতা মুন্সি বিহরিলাল নামে একজন ছেলে সন্তানকে দত্যক নেন।
পরে আশালতা মুন্সি মারা গেলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুন্সিলালের বংশধররা কলকাতায় চলে গেলে বিভিন্ন লোভের মহে মামলা মোকদ্দমার কারণে বেশ কয়েকবার বাড়ির মালিকানা বদল হয়। বর্তমানে উলিপুর মুন্সিবাড়ী বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে নিবন্ধিত আছে। আর মূল ভবনের দুইটি কক্ষ বিগত বহু বছর ধরনীবাড়ী ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখনও মূল ভবনের দরজার উপরে ধরণীবাড়ী ভূমি অফিসের সাইনবোর্ড দেয়া আছে। পরবর্তীতে ভূমি অফিসটি মুুন্সিবাড়ীর উঠানে সদ্য নির্মিত নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মূল অট্রালিকা ছাড়াও এখানে বেশকটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরের পশ্চিমে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, তুলসী পাঠ, মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে স্নান। বাথরুমের ভিতরে একটি কূপ আর অট্রালিকার সামনে একটি বিশাল সূর্য-জলাশয় পুকুর। সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটির নাট্য মন্দির, দূর্গা মন্দির, বিষ্ণ মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, বিছানা ঘর, ডাইনিং ঘর, রান্না ঘর, অঙ্কন ঘর, উপরের তলার বিশ্রাম ঘর ও বাথ রুম অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। নির্মিত ভবনের একটি শীলা খন্ডে ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দ উল্লেখ আছে। এ থেকে ধারনা করা হয় মুন্সিবাড়ী ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দেই তৈরী।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বৃষ্টি হলেই ছাদ চুয়ে চুয়ে কক্ষ ও বারান্দা বৃষ্টির পানি দিয়ে ভরে যায়। পার্শ্ববর্তী বসবাসরত কিছু পরিবার মুল ভবনের বারান্দায় গরু-ছাগল বেধে রাখে। এ ছাড়াও চোখে পড়েছে দূর্গা মন্দিরের বারান্দায় পাট কাঠির বোঝা, জ্বালানিতে ব্যবহারের জন্য লাকরি ও গাছের শুকনো পাতার স্তুপ। সর্বোপরি দেখা গিয়েছে যে যেভাবে পারছে সেভাবে বাড়িটি ব্যবহার করছে।
গোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত পংক চন্দ্র মহন্তের সাথে কথা হলে তিনি প্রতিনিধিকে জানান, আমি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে প্রতিদিন তিন বেলা পূজা আর্চনা দিয়ে আসছি। অবহেলা-অযত্নে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী বিখ্যাত উলিপুর মুন্সিবাড়ী।
এলাকাবাসীর দাবি, বাড়িটির পূর্বের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে অট্রালিকাটিকে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করে দর্শনীয় স্থান গড়ে তুললে যুগযুগ বেঁচে থাকবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী জমিদার আমলের ধরণীবাড়ীর স্মৃতি মুন্সিবাড়ী।
বর্তমানে ভবনটি যথাযথ সংস্কারের অভাবে বেহাল দশা, প্রয়োজনীয় সংস্কার করা না হলে ঐতিহ্যবাহী মুন্সিবাড়ীটি হয়তো স্মৃতির অন্তরালেই চলে যাবে।
//নিউজ/উলিপুর//মালেক/আগস্ট/২৬/২২