।। নিউজ ডেস্ক ।।
কালের স্রোতে চাপা পড়া বর্ণাঢ্য ইতিকথার মুক্ত মানিক ‘কাজীর মসজিদ’। এটি উলিপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে দলদলিয়া ইউনিয়নের দলবাড়ির পাড় গ্রামে অবস্থিত।
মুঘল আমলের এই মসজিদটি বালু সিমেন্ট ব্যবহার না করে সুরকি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন কারুশিল্পীরা। মসজিদের পুরাতন ভবনটি আকারে ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট শক্তভিত্তির উপর দন্ডায়মান। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট ও প্রস্থ ১৩ ফুট। দেয়ালের পুরত্ব প্রায় আড়াই ফুট। যা বর্তমানে মসজিদটির ছাদে ৫টি গম্বুজ ও ছোট ছোট ৪টি মিনার সম্প্রসারিত করেছে। অতি পুরাতন হওয়ায় মসজিদটির কিছু অংশ মাটিতে দেবে গেছে। মূল মসজিদের মধ্যে একটি ছোট মেহরাব রয়েছে, জুমার দিন খতিব এখান থেকে বয়ান পেশ করেন। মসজিদটির ভেতরে ১৫/২০ জন একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। ভেতরে সাদা মাটা থাকলেও বাইরে খচিত অলংকরণ বেশি হওয়ায় আরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এই মসজিদটি সম্প্রসারিত করে অত্যাধুনিক ও নিপুণ কারুকাজে সৌন্দর্যবর্ধনে প্রসারিত করা হচ্ছে।
এ নিদর্শনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মসজিদের পূর্বদিকে প্রাচীনকালের সান বাঁধানো একটি পুকুর ও নতুন একটি কবরস্থান। মসজিদের উত্তরে ঈদগাহ মাঠ, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং, দক্ষিণে নুরানি মাদ্রাসা ও পশ্চিমে কবরস্থানসহ প্রায় ৩ একর জমি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী কাজীর মসজিদের পুরাতন ভবনকে ঘিরে গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক প্রচলিত কথা যা হার মানায় রূপকথাকেও। কখন, কিভাবে নির্মিত হয়েছে তার সঠিক কোন ইতিহাস আজও জানা যায়নি। এ ব্যাপারে দু’টি মতবাদ রয়েছে, মসজিদটি আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন যা গায়েবিভাবে ভূগর্ভ থেকে উঠে এসেছে, অন্যটি সেই মুঘল আমলের কাজী কুতুব উদ্দিনের তৈরি।
উলিপুরের ইতিহাস ও লোকসাহিত্য গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১২১৪ হিজরি সনে পারস্য (ইরান দেশ) থেকে কাজী কুতুব উদ্দিন নামের একজন ধর্মযাজক ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য এ অঞ্চলে এসে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি এলাকায় ধর্ম প্রচার করে মুসল্লিদের নিয়ে এই মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে এলাকার মুসল্লিরা দীর্ঘসময় সেখানে নামাজ আদায় করেন। ধীরে ধীরে সেখানকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মসজিদটি ঝাড় জঙ্গলে ঢেকে যায়।
মসজিদটির নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের সমাধান হয়, মূল মসজিদের প্রবেশের পথে একটি ফার্সি ভাষার শিলালিপি থেকে জানা গেছে। যার বঙ্গানুবাদ : পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ্ ছাড়া মাবুদ নাই, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। কাজী কুতুব উদ্দিন, ঈমানি দৃঢ় বিশ্বাসে পবিত্র আল্লাহর ঘর মসজিদ নির্মাণ করেন। নবী (সাঃ) এর অসিলায় প্রতিষ্ঠার কাজ সোমবারে সমাপ্ত হয়েছে।
হিজরি সাল তালাশ করে জানা যায়, এক হাজার দুইশ চৌদ্দ সন। মসজিদটির নির্মাতা কাজী কুতুব উদ্দিন। তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘কাজীর মসজিদ’। ধারণা করা হয়, তিনি ছিলেন এ উপ-মহাদেশে ধর্ম প্রচার করতে আসা রাসুল (সাঃ) এর নায়েবে নবী। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ কাজীর মসজিদটি অধিগ্রহণ করে।
সপ্তাহে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এক নজর মসজিদটি দেখা ও মানতের জন্য ভিড় করছেন। জুমার নামাজ আদায়ের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১৫ শতাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাগম ঘটে।
কথিত আছে, এই মসজিদে কেউ কিছু মানত করে দান করলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। মসজিদটিকে কেন্দ্র করে প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলী মানুষজনও বিভিন্ন মানত (নগদ টাকা, গুড়, চিনি, খোরমা, জিলাপি, পায়েস, খিচুড়ি, হাঁস-মুরগি, ছাগল, চাল, ডাল ও ধর্মীয় বই) নিয়ে এসে মসজিদ কমিটির হাতে তুলে দেন। এসব মানত ও দান থেকে প্রতিমাসে প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকা উপার্জিত হয় ।
কাজীর মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুস সবুর জানান, আমি দীর্ঘ ৫০ বৎসর ধরে এই মসজিদের প্রধান খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। যতটুকু জানি, মসজিদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। একসময় এলাকার লোকজন মসজিদটি আবিষ্কারের পর পুনঃসংস্কার করেন। তখন থেকে মূল মসজিদটিতে ১৫/২০ জন মুসল্লি নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামের সাথে কথা তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহের দান ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মূল মসজিদটি ঠিক রেখে ৫ তলা ভবনের ভিত্তি দিয়ে ২য় তলার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
আজ থেকে প্রায় ২’শ ২৮ বৎসর আগের মুঘল আমলের বিশেষ স্থাপত্যের তৈরির স্মৃতিচিহৃ ‘কাজীর মসজিদ’ উত্তরবঙ্গে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্থাপত্যের শৈলিতে যেমন মোঘল আমলের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন, তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশে সমগ্র মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম চিত্রাকর্ষক স্থাপনা এই মসজিদ।
//নিউজ/উলিপুর//মালেক/আগস্ট/১০/২২