।। উপজেলা প্রতিনিধি ।।
প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের উপবৃত্তি থেকে রৌমারীর যাদুরচর ডিগ্রি কলেজের ১৬৯ জন শিক্ষার্থী বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপবৃত্তি বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় কলেজ পরিচালনা কমিটির সাথে অধ্যক্ষের দ্বন্দ্বকে দায়ী করছেন অভিভাবকরা।
উপজেলা শিক্ষা অফিস ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে, দারিদ্রপীড়িত ও পিছিয়ে পড়া এলাকা বিবেচনায় সরকার রৌমারী উপজেলাকে শতভাগ উপবৃত্তির আওতাভুক্ত করে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যাদুরচর ডিগ্রি কলেজের ১৬৯জন শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপবৃত্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও জমা দেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবহেলার কারণে সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের কাগজপত্রসহ অনলাইনে বা সরাসরি জমা করা হয়নি উপবৃত্তি কার্যালয়ে। ফলে উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হলো শিক্ষার্থীরা। সরকারের এমন সহায়তা কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছেন কলেজ সংশ্লিষ্ট সকলে। অথচ ২১ এপ্রিলের আবেদনের শেষ তারিখ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির উপ-পরিচালকের এক চিঠিতে বলা হয়,‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে সৃষ্ট যে কোনো সমস্যার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন।’
যাদুরচর ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী ডিগ্রী পাশ ছাড়া ডিগ্রি কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে পারবেন না। ২০১৫ সালে যখন যাদুরচর কলেজে স্নাতক বা ডিগ্রি শ্রেণিতে পাঠদানের অনুমতি লাভ করে। তৎকালীন এমপি মো. রুহুল আমিন পদাধিকার বলে কলেজটি সভাপতি নিযুক্ত হন। পরে ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে আবার মজিবুর রহমান নকল ডিগ্রি পাশ সনদে সভাপতি নির্বাচিত হন। কলেজ অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম নকল সনদের বিরুদ্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ যাচাইয়ের জন্য আবেদন করেন। বোর্ড তদন্তে সনদ জাল প্রমানিত হলে তার সভাপতি পদ চলে যায়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই নিয়ে অধ্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। গত ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গভর্নিং বডির অনুমোদন দেন। এলাকার মো. আব্দুস সালাম মন্ডল সভাপতি দায়িত্ব পান। সভাপতি অনুমোদনকৃত সদস্যদের নিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম সভা করা জন্য নোটিশ খাতায় সকল সদসের স্বাক্ষর নেন। পরে সভা না করে গোপনে সভাপতি আব্দুস সালাম মন্ডল, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী, শিক্ষক প্রতিনিধি উপাধ্যক্ষ সফিকুল ইসলাম, আনছার আলী প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), রফিকুল ইসলাম (প্রভাষক বাংলা) যোগসাজসে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলামকে সাময়িক বহিস্কার করেন এবং উপাধ্যক্ষ সফিকুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যেক্ষের দায়িত্ব দেন। এই নিয়ে চলে মামলা মোকদ্দমা। ফলে যথাসময়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় বা শিক্ষাবিভাগে কলেজ কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে দাপ্তরিক কাজ কর্ম করতে পারেন না। অভিভাবকরা মনে করেন এই পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের কারণে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে ওই কলেজের ১৬৯ জন শিক্ষার্থী।
ওই কলেজের ২০২১-২২ শিক্ষবর্ষের শিক্ষার্থী শফিক আহম্মেদ, আরিফুল ইসলাম, সামিউল ইসলামসহ অনেকে জানান, কলেজ কর্তৃক নিদের্শনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র কলেজের অফিস কক্ষে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীও উপবৃত্তির টাকা পায়নি। যাদের চক্রান্তে এমন ঘটনা ঘটেছে তাদের বিচারসহ উপবৃত্তির আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান তারা।
যাদুরচর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির তালিকা পাঠাতে অফিস সহকারী মোস্তাফা কামাল ও মাসুদ পারভেজকে লিখিত নির্দেশনা দিলেও তারা তা মানেননি। এ কারণে ১৬৯জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ ঘটনায় অফিস সহকারী মোস্তফা কামাল ও মাসুদ পারভেজকে শোকজ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এর আগে ২০২১সালের ১১ অক্টোবর কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুস সালাম ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মজিবুর রহমান বঙ্গবাসী মিলে আমাকে অবৈধভাবে সাময়িক বহিষ্কার করে ওই কলেজের উপাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন এবং আমার অফিস কক্ষসহ একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। ওই দিনই বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছিল। তিনি দাবী করেন, অভিযোগের আলোকে গত ১২অক্টোবর রৌমারী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও একাডেমিক সুপার ভাইজার সরেজমিন গিয়ে কলেজের একাডেমিক ভবনের তালা খুলে দেন।
অধ্যক্ষের (রফিকুল ইসলাম) আদেশ পাওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির তালিকা পাঠাতে না পারার কথা স্বীকার করে যাদুরচর ডিগ্রি কলেজের অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোস্তাফা কামাল বলেন, ‘উপবৃত্তির তালিকা তৈরির শুরুতে এ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম তাদের এ কাজে বাঁধা দেন। তিনি বলেন, ‘ছোট চাকুরী করি। চাকুরী হারানোর ভয়ে ওই সময় তালিকার কাজ করা থেকে বিরত থাকি।’
তবে আরেক অফিস সহকারী মাসুদ পারভেজ বলেন,‘আমরা উপবৃত্তির জন্য শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছিলাম। তার দাবী, কলেজ কর্তৃপক্ষ কখনো তাদের দিয়ে অনলাইন বা কম্পিউটারের কাজ করান না।’
অফিস সহকারীদের কাজে বাধা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে উপাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘উচ্চ আদালত থেকে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলামের রায় পাওয়ার বিষয়টি ২০ মার্চ ২০২২ তারিখে চিঠি পেয়ে আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে সরে আসি। কর্মচারীদের হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা।’
রৌমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আইবুল ইসলাম বলেন, এঘটনায় আমি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরেও তারা কাজ করেননি। শেষ দিন অনেক যোগাযোগ করেও তাদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির অনলাইন করাতে পারিনি। মূলতঃ কলেজ পরিচালনা কমিটির সাথে অধ্যক্ষের মামলা মোকদ্দমা ও ঠেলাঠেলির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের আলোকে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, এ ঘটনায় একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত পূর্বক প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।