।। নিউজ ডেস্ক ।।
দ্রুত গতিতে পানি হ্রাস পাওয়ায় ও বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় কুড়িগ্রাম জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কমেনি মানুষের দুর্ভোগ। তবে চর ও নদ-নদীর অববাহিকার নিচু এলাকাগুলোতে এখনও পানি জমে আছে। পানিবন্দী রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকের ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও সেগুলো বসবাসের উপযোগী হয়নি। দুর্গম চরাঞ্চলে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্যসেবা সংকট চলছে ও চাহিদা মাফিক নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ। অনেক জায়গায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙ্গন। গ্রামীণ ও চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় যাতায়াতে ভোগান্তি বেড়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে যাওয়ায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, বন্যায় জেলায় প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় ৭ হাজার কৃষক। পুরো পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, চলতি বন্যায় প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত ৫৩৮ মেট্রিকটন চাল, ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার উপ-বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম চলমান আছে।
সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগ বানভাসীদের দুর্ভোগ কমাতে পারেনি। অনেক চরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ত্রাণ পৌছেনি। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার এবং গো খাদ্যের তীব্র সংকট স্পষ্ট। বন্ধ হয়ে যাওয়া ৩২৫টি স্কুলের পাঠদান কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। সরেজমিনে এসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মানুষের চরম দুর্ভাগের চিত্র। নিজ চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করানো মুশকিল।
নদী ভাঙ্গা মানুষের বিলাপ ব্রহ্মপুত্র নদের পেটে অবস্থিত হকের চর। নদির পানি কমার সাথে সাথে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙ্গন। দুদিনে এখানকার ৯টি পরিবার ভিটে-মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এদের মধ্যে আমিনুল মিস্ত্রী (৬০) ও আলহাজ মিস্ত্রী (৩৫) বাড়ি-ঘর নৌকায় তুলে যাচ্ছেন গুজিমারীর চরে। মাঝ নদীতে দেখা মেলে এ দু’পরিবারে সাথে। তাদের পিতা রফিকুল মিস্ত্রী (৮০) নৌকার ছইয়ের উপর বসে উদাসভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন। পরিবারের মহিলা ও শিশুরা ছইয়ের ভিতরে। আর পুরো নৌকা জুড়ে দুটি পরিবারের ঘরের চালসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। কয়েক দফায় এসব মালামাল স্থানান্তর করতে হবে। এটি ছিলো প্রথম ধাপ। এ জন্য নৌকা ভাড়া বাবদ দিতে হবে পুরো আট হাজার টাকা। এমনটাই জানালেন বর্ষিয়ান রফিকুল মিস্ত্রী।
তিনি আরো জানান, ‘বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে ব্রহ্মপুত্র রাক্ষুসী রূপ ধারণ করে পাকদিয়ে ভাঙ্গা শুরু করে দুইদিনে আমার দু’ছেলের বাড়িসহ ৯জনের বাড়িভিটা ভেঙ্গে নিয়ে যায়। সবাই এখন খোলা আকাশের নীচে। গুজিমারীর চরের বাবু’র ১২শতক জমি ২০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছে আমার দু’ছেলে। ঐখানে যাচ্ছি নতুন ঠিকানা গড়তে। পেশায় সবাই কাঠমিস্ত্রী। তার জীবনে এর আগে আরো ৬বার বাড়ি ভেঙ্গেছেন। প্রথমে ছিলেন বাগুয়ার চর । সেখান থেকে হকের চরে । এবার ঠিকানা হবে গুজিমারীর চরে। কতদিন স্থায়ী হতে পারবেন তাও জানা নেই। এই ভাঙ্গা গড়ার খেলায় তাদের জীবন চলছে। হকের চরের ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব মাইদুল, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ দফাদার, আম্বর আলী, আনোয়ার আলী ও মুকুল এখনও মাথা গোঁজার ঠাঁই পায়নি। এরকম দুর্যোগের সময় চেয়ারম্যান মেম্বার কারো দেখা নেই এলাকায় এই আক্ষেপ তাদের কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।
আমিনুল মিস্ত্রীর স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, এখন হাতে কোন কাজ নেই। নতুন চরে যাচ্ছি যদি কেউ কোন খাওন দেয় তো পেটে দানাপানি পড়বে না হলে উপোস করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ রান্না করারও কোন সুযোগ নেই। আলেমা খাতুন বলেন, ঘর ভাঙ্গছে খাই কেমনে। শিশু সন্তান আনিস চিরা মুড়ি খাইছে। কষ্টের শেষ নাই।
শিশু আনিস (প্রথম শ্রেণীর ছাত্র) অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘চারদিকে নদী আর পানি ভালোলাগে না। খেলতে পারি না, স্কুলে যেতে পারি না, খাবার কষ্ট। তাই মন খারাপ।’ যেন সব শিশুদেরই একই রকম মন খারাপ।
আমিনুল মিস্ত্রী বলেন, ঘর ভাঙ্গা মানুষের যে কি কষ্ট তা কেউ বুঝবে না ভুক্তভোগী ছাড়া। ধারদেনা করে চলছি। বাকীটা আল্লাহ ভরসা।
আনন্দ বাজারে মানুষের আনন্দ নেই।
সাহেবের আলগা ইউনিয়নের দুর্গম চর বাগুয়া। চতুর্দিকে নদী মাঝে এ চরে নেই স্কুল নেই হাটবাজার। তাই এলাকর জুরান, মজিবর শেখ ও কুরফান দেওয়ান মিলে তিন একর জমির উপর গত বছর অক্টোবর মাসে আনন্দ বাজার নামে হাট বসায়। আনন্দ উৎসবে যে বাজার বসায় এলাকাবাসী বছর না ঘুরতে নদীর বাঁক বদলে যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তাতে সবার আনন্দ উবে যায়। এ বাজারে বিভিন্ন ধরণের ৩৫টি দোকান ঘর ছিলো। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভেঙ্গে গেছে ১৫টি দোকান।
হারেছ মোল্লা জানান, রহমত আলী, আক্কাস মোল্লা, বিপুল উদ্দিন, আমিনুল ডাক্তার (গ্রাম্য চিকিৎসক), আকবর মোল্লা, তারা চাদ, আল আমিন, এবাদ মোল্লা, জোমসেদ মন্ডল, মোসলোম ডাক্তার (গ্রাম্য চিকিৎসক), মজিদ মিস্ত্রী, বাবু, ইব্রাহীম, আক্তার ও ঝরু মিয়ার দোকান ঘর ভেঙ্গে গেছে নদীতে। এখন এ বাজারটি টিকবে কিনা এ দুশ্চিন্তা সবার।
এলাকার গৃহস্থ আক্কাস আলী জানান, নদীর ভাঙ্গন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। চলতি বন্যা মৌসুমে আনন্দবাজার সংলগ্ন চর বাগুয়ায় ৩৪টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ভাঙ্গনে নি:স্বরা হলেন লাল মিয়া, ময়চাল, নুরল, আছর উদ্দিন, ফজল, আনছার, অহিজ উদ্দিন, আব্দুস সামাদ, রেখাত মোল্লা, হারেজ মোল্লা, সিরাজুল, হাফিজুল, শরিফ, রহিছ উদ্দিন, জুরান, সাইফুল, ছকিনা বেওয়া, সালাম, কলিম উদ্দিন, আব্দুর রশিদ, সাঈদ, এনামুল, ছকুমুদ্দিন, ইসলাম, হারিছ আলী, রশিদুল, শাহিদা বেগম, বাদশা মিয়া, শুকুরজান, শাহালম, সবুরা, নুর ইসলাম, খোরশেদ, সফিয়াল ও করিম বাদশা।
এসব ব্যাপারে কথা হয় সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবু সায়েমের সাথে। তিনি দাবি করেন গুজমারী চরে ৫টি গ্রাম। গ্রামগুলো হলো-গুজিমারী, হকের চর, কাজিয়ার চর, জোদ্দার পাড়া ও পূর্ব পাড়া। প্রায় ৩হাজার মানুষের বসবাস হলেও এখন পর্যন্ত কোন ত্রাণ সহায়তা দিতে পারেননি কারণ অপ্রতুল ত্রাণ এবং এলাকাগুলো দুর্গম । চলতি বন্যায় এখানকার ১৫১টি পরিবার ভাঙ্গনে ভিটেমাটি হারিয়েছে মর্মে তালিকা করে ইউএনওকে দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। তার ভাষায় চলতি বন্যায় গজব পড়েছে গুজিমারী চরে।
‘বানের পানিত ভাইসপার নাগছি গত ১৫দিন থাকি। আল্লাহ চলবার নাগছে। একবেলা খাই একবেলা উপোস করি। ছোট তিনটা ছাওয়া নিয়া বিপদে আছি। ওমরা তো অভাব বোঝে না। খালি খাবার চায়। কিন্তু ঘরোত তো খাওন নাই। আইজ সকালে ওরা তিন ভাইবোন এক মুট করি পন্তা খায়া আছে। আমরা দুই মানুষ এক মুট চিড়া খায়া আছি। এক কেজি চাউল ধার করি আনছি বিকালে আছরের আজান দিলে রান্দমো। একমুট ডাইলও আছে। উইয়াকে ৫জনে একমুট করি খামো বাকিটা ফির রাইতোত খামো। কাইল কি হইবে তাক জানা নাই।’ তিন মাসের গর্ভবতী আনিছা বেগম তার দুর্শার কথা জানান এভাবে। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপূত্র নদের পেটে অবস্থিত বাবুর চর। এখানকার কৃষি শ্রমিক সাইফুলের স্ত্রী আনিছা। দুই মেয়ে এক ছেলে। সাথী আক্তার (১০), সুমী (৫) এবং রাশেদুল (২)। এরপর আবার তিনি ৩ মাসের অন্ত:স্বত্বা। নেই পুষ্টি কিংবা স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ। সাইফুল জানান, বন্যা শুরু হয়েছে থেকে হাতে কোন কাজ নেই। সঞ্চয় যা ছিলো তাও শেষ। এখন সম্পুর্ণ ধার কর্জের উপর চলছি। তিন বেলা পেটপুরে খাবারই জোটেনা পুষ্টিকর খাবার পাবো কোথায়। চেয়ারম্যান মেম্বার কেউ খোঁজ নেয়নি। দেয়নি কোন ত্রাণ। বৃহস্পতিবার কিছু ছাত্র এককেজি চিড়া এবং এক পোয়া গুড় দিছে। গত দু সপ্তাহের খাদ্য তালিকায় কী ছিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে জানান, একদিন মাছ খাইছি। আর বাড়ির মুরগীর ডিম চারদিন। মাংস কিংবা দুধ জোটেনি। শুধু ভাত, পাট শাক, ডাল আর লবণ মরিচ। এরকম অবস্থা এই বাবুর চরের ৯টি পরিবারের। পরিবারগুলো হলো-শাহের আলী, ছক্কু মিয়া, সাইফুল, কবির উদ্দিন, আতাউর, আলম, তাইজুল, ফারুক এবং বক্করের পরিবারের। তাদের ভাগ্যে সরকারি কোন ত্রাণ পৌঁছেনি গত ১৫দিনেও। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে ত্রাণের কোন অভাব নেই।
শুক্রবার দুর্গম বাবুর চরে সরেজমিন গেলে কোমর পানি ভেঙ্গে নৌকা ঘিরে ধরে শিশু নারী সহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তাদের আকুতি ‘হামার গুলার কথা একনা লেখেন বাহে। ছাওয়া-পোয়াগুলাক নিয়া খুব কষ্টে আছি। খাবার নাই। পানির কষ্ট। ছইল-পইল মানুষ না খায়া থাইকপার পায় না। হামরাগুলা না হয় একবেলা খায়া থাকলোং।’ কৃষ্ণা বালা বলেন, নিজেরে খাবার নাই এলা ছাগল আর মুরগীক কি খাওয়াই। মহাবিপদ হইছে। তাই ছাগলের জন্য পাটের পাতা ছিড়ি আনলোং। উয়াকে হামরাও খামো আর ছাগলও খাইবে। সম্বরি বেওয়া বলেন, ‘সকাল থেকে কিছু খাই নাই। আধা কেজি চাউল আছে বিকালে রান্দমো। সাথে কলাগাছের মাজা সিদ্ধ করে খামো। তাকে দিয়া রাইতোতও চলবে।’
নদীর মাঝে চোখে পড়ে এক ব্যক্তি নৌকায় ৫/৬টি ছাগল নিয়ে পাটক্ষেতের ভিতরে ভিতরে যাচ্ছে আর ছাগল মুখ বাড়িয়ে পাটের পাতা খাচ্ছে। মালিক শহিদুল বলেন, নিজেদের খাবার জোটে না, ছাগলগুলাক বাচাই কেমনে। কোথাও কোন ঘাস নেই। তাই নিরুপায় হয়ে পাট ক্ষেতে নৌকায় করে আনছি। গবাদি পশুর তীব্র খাদ্য সংকট চলছে।
হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, অপ্রতুল ত্রাণ সহায়তার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আর দুর্গম চরাঞ্চলের অবস্থা খুবই খারাপ।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জের চর মশালের চরের বাসিন্দা মুসা মিয়া জানান, গ্রামের অধিকাংশ লোকের ঘর থেকে পানি নামলেও আঙিনা ও বাড়ির চারপাশে পানি জমে আছে। এই গ্রামের কৃষক মাইদুল ইসলাম, তৈয়ব আলী ও সিদ্দিক মেম্বার জানান, বন্যার পানিতে পাট ক্ষেত ডুবে ছিল। এখন পানি কমে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে বালু পড়ে পাটক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।