।। নিউজ ডেস্ক ।।
রাজারহাট উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে উদ্যোক্তা তৈরির নামে সরকারের লাখ-লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন। প্রতি বছর প্রশিক্ষণ হলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কাজে লাগছে না প্রশিক্ষণার্থীদের। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণীর মদদে প্রতি ব্যাচে থাকছে ভুয়া প্রশিক্ষণার্থীর নাম।
ভুয়া নামে সরকারে অনুদানের পুরো টাকা করেন নিজে আত্মসাৎ করে। ফলে নারী উন্নয়নে সরকারে নেওয়া উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে।তিনি একই সঙ্গে কুড়িগ্রাম সদর এবং রাজারহাট উপজেলার দায়িত্বে থেকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। তাকে পাওয়া যায় না অফিসে কিংবা ফোনে।
এমন অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু বলেন, মহিলা মানুষ বলার কিছু নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাইনবোর্ড বিহীন তিন তলা ভবনে রাজারহাট উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যালয়টি। ভিতরে প্রবেশ করে চিত্র দেখে কারোরই মনে হবে না এখানে নারী উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যে যার মতই গল্প গুজবে ব্যস্ত সময় পার করছে প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থীরা। চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরের বিউটি ফিকেশন এবং ফ্যাশন ডিজাইন কোর্সের ১৪ ও ১৫তম ব্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিন মাস মেয়াদি বছরে ৪টি কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি কোর্সে সকাল ১০টা হতে দুপুর ১টা এবং বিকেল ২টা থেকে ৫পর্যন্ত প্রশিক্ষণে ২টি ব্যাচে ১০০জন নারী উদ্যোক্তা অংশ নেয়।
তিন মাসের কোর্সে সরকারি ছুটিসহ অন্যান্য বন্ধের কারণে প্রশিক্ষণ হয় ৬০দিন। প্রতিদিনের ভাতা হিসেবে ২শত টাকা হারে প্রশিক্ষণার্থীরা ১২হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে সেই টাকা এক থেকে দু’হাজার টাকা কর্তন করে বাকি টাকা প্রশিক্ষণার্থীদের দেয়া হয়। এছাড়াও প্রশিক্ষণের উপকরণের জন্য প্রতি ব্যাচে ৬হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও নেই কোন উপকরণ।
প্রশিক্ষণার্থীদের নিকট হতে চাঁদা তুলে উপকরণ ক্রয় করা হয়। বিধি অনুযায়ী ৮ম শ্রেণীর পাশের ১৬ হতে ৪২বছরের অবহেলিত-বঞ্চিত নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। কিন্তু বিধি তোয়াক্কা না করেই অফিস সহকারী রেয়াচত আলী তার নিজের তিন মেয়ে এবং অফিসের অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী ফাতেমা বেগমসহ পছন্দের নারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত থেকেও প্রশিক্ষণের ভাতা নিচ্ছেন তারা।
উদ্বেগজনক তথ্য হলো প্রতি ব্যাচে ৫-৬জনের ভুয়া নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। এদের নামে উত্তোলনকৃত পুরো টাকা যায় কর্মকর্তার পকেটে। সিনিয়র প্রশিক্ষক রেজিয়া খাতুনও অফিসে আসেন না। মাসে একদিন এসে সব স্বাক্ষর করেন। একই ভাবে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণী মাসে দু-একবার এসে অফিস করেন। অফিস সহকারী রেয়াচত আলীর তত্বাবধায়নে চলে অফিস। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে এভাবেই প্রতি ব্যাচে সরকারের বরাদ্দকৃত প্রশিক্ষণার্থীর ভাতার টাকা থেকে ৩-৪লাখ টাকা আত্মসাৎ করছে অফিসের সিন্ডিকেট চক্রটি। এছাড়া উপকরণে ক্রয়ের জন্য বরাদ্দকৃত ৯০হাজার টাকাও যায় পকেটে।
প্রশিক্ষণার্থী মিনারা বেগম বলেন, এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসছি। নিজে কিছু করার জন্য। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না। এখানে কোন প্রডাক্ট নেই। এসে গল্প গুজব করে সময় পার হয়। একশ টাকা করে নিয়েছে প্রডাক্ট আনবে বলে। আজও সেই প্রডাক্ট নেই। ফলে কোন কিছু শেখাই হচ্ছে না।
আরিফা আক্তার বলেন, আমাদের কোন কিছু শেখানো হচ্ছে না। বিউটি ফিকেশনের প্রশিক্ষণ নিলেও এখানে কোনো প্রডাক্ট নেই। আমাদের নিজেদের প্রডাক্ট নিয়ে এসে একটু একটু শিখছি। প্রায় দুমাস হলো প্রশিক্ষণের সেখানে আমরা ভ্রু,চুল আর ফেসিয়াল শিখাইছে। কিন্তু পার্লারের ম্যানলি বউ সাজ আমরা শিখতে পারি নাই। ফেসিয়ালের যেটা আসল সেটাই আমরা শিখতে পারি নাই।
লাবনী বলেন, আমরা ব্যাচে ২৫জন আছি। আমরা দু’মাস ধরে নিয়মিত উপস্থিত থেকে ক্লাস করছি ২১জন। অথচ স্বাক্ষর হচ্ছে ২৫জনের। কোথায় কিভাবে স্বাক্ষরগুলো হচ্ছে আমরা জানি না। প্রতিদিন ক্লাসে ২১জনের স্বাক্ষর করি আমরা আর পরের দিন ক্লাসে এসে দেখি ২৫জনের স্বাক্ষর।
প্রশিক্ষক ফাহমিদা হক রুপা প্রশিক্ষণার্থীর উপস্থিতির বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও তাদের নিকট থেকে জন প্রতি ১০০ টাকা নেবার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন প্রডাক্ট কেনার জন্য টাকা তুলে জয়ন্তী রাণী ম্যাডামকে (উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা) দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উনি বলতে পারবেন।
অস্থায়ী পরিচ্ছন্নকর্মী ফাতেমা বেগম বলেন, আমাকে অফিস থেকে মাসে এক হাজার টাকা বেতন দেয়। আর আমার নাম প্রতিটি ব্যাচেই অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। সেখান থেকে সামান্য কিছু টাকা দেয়। এছাড়া আর কোন টাকা পাই না।
এই বিষয়ে অফিস সহকারী রেয়াচত আলী প্রথমে নিজের মেয়েদের কথা অস্বীকার করেন। পরে প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের চাপে তার তিন মেয়েকে নিয়মিত প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা স্বীকার করেন। তাদের হয়ে নিজেই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেবার কথা স্বীকারও করেন অকপটে।
এছাড়াও তিনি আরও বলেন, চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরে মোট প্রশিক্ষণার্থী ২০০ জন। তাদের উপকরণে ক্রয়ের জন্য ৯০হাজার টাকা এবং ভাতা হিসেবে ২৪লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তবে তিনি যা করেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণীর নির্দেশে করেন বলে যোগ করেন।
সিনিয়র প্রশিক্ষক রেজিয়া খাতুন বলেন, আমার অফিস কাজ করার কথা থাকলেও লোকবল কম থাকায় আমাকে দিয়ে ফিল্ডে কাজ করানো হয়। ভিজিডি, নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মামলা-কোর্ট এগুলো আমাকে দেখতে হয়। যদিও আমার এগুলো কাজ নয়। কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমাকে ফিল্ডে যেতে হয়। এজন্য আমার কোন টিএডিএ দেয়া হয় না। বরাদ্দ আছে কিনা আমার জানা নেই?
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণীকে অফিসে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক অফিস স্টাফ বলেন, উদ্যোক্তা তৈরির নামে সরকার যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তা কোন কাজে আসছে না। রাজারহাট উপজেলায় শত-শত নারী প্রশিক্ষণ নিলেও তা শুধু কাগজ কলমে। লোক দেখানো প্রশিক্ষণের নামে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
চোখের সামনে এতো অনিয়ম হলেও জানা নেই প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিমের। তিনি বিস্তর অভিযোগ শুনে নিজেও হতবাক বনে যান। অনিয়মের তথ্য জানতে পেরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোছা. জেবুন্নেছা স্বীকার করেন অফিসের পরিচ্ছন্নকমীকে প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে দেখানোর আইনত কোনো সুযোগ নেই। কুড়িগ্রামে নতুন যোগদান করায় সব বিষয় তার নলেজে নেই। তবে তিনি উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন।
কুড়িগ্রাম-২ (কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলা) আসনের সাংসদ আলহাজ্জ পনির উদ্দিন আহম্মেদ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সর্বত্র ব্যাপক অনিয়ম চলছে দেখার কেউ নেই। সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি ধরার, সুপারভেশন করবার তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। ফলে জনদুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। আমরা অসহায়।