।। নিউজ ডেস্ক ।।
কুড়িগ্রাম শহরে বিকিরণ কমার্স এন্ড বিজনেস লিমিটেড নামে একটি ভুঁইফোড় কোম্পানির বাহারি প্রচারণা আর শরীয়তি লেবাসে আকৃষ্ট হয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা খুঁইয়ে প্রায় দেড়শ’ গ্রাহক সর্বশান্ত হয়েছেন। শরীয়াভিত্তিক ব্যবসায় হালাল মুনাফা পাওয়ার আশায় সর্বম্ব বিনিয়োগ করে এখন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা হা-হুতাশ করছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ভুক্ত জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে বিকিরণ কমার্স এন্ড বিসনেস লিমিটেড নামে ব্যবসা শুরু করে কুড়িগ্রামের এই কোম্পানিটি। শরীয়াভিত্তিক মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬টি আমানত প্রকল্পে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। ডকুমেন্ট হিসেবে দেয়া হয় ৫০-১৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প। শরীয়াহ্ বোর্ড ও উপদেষ্টা পরিষদে স্থানীয় আলেম ও ব্যবসায়ীদের নাম ব্যবহার করে সুকৌশলে কার্যক্রম শুরু করে তারা। মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক-এই কয়েকটি ক্যাটাগরিতে আকর্ষণীয় মুনাফা দেয়ার কথা বলে দেড়শ’ গ্রাহকের প্রায় ২ কোটি টাকা টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। কেউ কেউ বিভিন্ন মেয়াদী মুনাফাও পেতে শুরু করে। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার অজুহাতে মুনাফা প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে অফিসে সাইনবোর্ড ছাড়া নেই কোন কার্যক্রম। আমানতকারীরা বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছেনা।
কোম্পানির গ্রাহক কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হরিশ্বরকালোয়ার বাসিন্দা বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান বলেন, শরীয়াভিত্তিক ব্যবসায় হালাল মুনাফা পাওয়ার আশায় সর্বম্ব বিনিয়োগ করে এখন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিস্ব হয়েছি। তিনি বলেন, ‘আমার ৬ লাখ টাকা জমা আছে বিকিরণে। এখন কোন টাকাই ফেরত পাচ্ছিনা। আমার মতো দেড়শ লোকের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়েছে কর্মকর্তারা। আমানতকারীদের টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে তারা জমি ও বাড়ির মালিক হয়েছে। আর গ্রাহকরা হয়েছে নি:স্ব।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম গণপূর্ত বিভাগের সামনে ‘বিকিরণ কমার্স এন্ড বিসনেস সেন্টার’ নামে কোম্পানির একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। পাওয়া যাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাওলানা হাফিজুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম আলীকে। দুজনেই আলোচিত কোম্পানি আল হামীম এর সাবেক কর্মকর্তা। পাওনাদারের চাপে মাওলানা হাফিজুর কুড়িগ্রাম শহরের ডাকবাংলা পাড়ায় ভাড়া বাসা ছেড়ে ভোগডাঙায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন। আর আদম আলী গা ঢাকা দিয়ে আছেন অজ্ঞাতস্থানে। তিনি গ্রাহকদের ফোনও ধরেননা।
বিকিরণে আমানত জমা দিয়ে নি:শ্ব প্রায় দেড়শ পরিবার। এদের কেউ চাকুরি শেষে অবসরকালীন টাকা, কেউ ব্যাংক ঋণের টাকা, কেউ জমি বিক্রি বা হজ্বে যাওয়ার জন্য জমা করেছিলেন এসব অর্থ। কিন্তু প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এখন কান্না তাদের নিত্যসংগী।
উলিপুর উপজেলার পাঁচপীর এলাকার আব্দুল আখের জানান, চাকুরি থেকে অবসরের পর ৫ লাখ টাকা জমা করে ২ লাখ টাকা ফেরত নেন। বাকী ৩ লাখ টাকার লভ্যাংশ ২০২০ সাল থেকে পাচ্ছেননা। এখন অফিস বন্ধ। একই এলাকার এরশাদ আলী জমি বিক্রির ৪ লাখ ও নজরুল ইসলাম ঋণ করে ৩ লাখ টাকা জমা দিয়ে এখন হা-হুতাশ করছেন।
চিলমারী উপজেলার জাহেদা বেগম জানান, তিনি মাসিক লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় ২০১৮ সালে ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এক বছর মুনাফা দেয়ার পর আর কোন টাকা দিচ্ছেনা।
ফুলবাড়ী উপজেলার ফারজানা জানান, তার স্বামী ওসমান গণি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৫ লাখ টাকা মেয়াদী স্কিমে আমানত দেয়ার পর মেয়াদ শেষে এখন অফিসের কাউকে পাওয়া যাচ্ছেনা।
কাঁঠালবাড়ী নুরুল্লাহ্ ফাজিল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘শরিয়া মোতোবেক লভ্যাংশের কথা শুনে আমি ও আমার স্ত্রী ২০২১ সালে হজ্বে যাওয়ার নিয়তে টাকা জমা দেই। কিন্তু মেয়াদ শেষে টাকা ফেরত পাচ্ছিনা। রাজারহাটের বৈদ্যেরবাজারের শহিদুল ইসলাম জানান, তার নিজের দেড় লাখ টাকাসহ ভাইবোন মিলে ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা মাসিক লভ্যাংশ দেয়ার শর্তে বিনিয়োগ করেছেন বিকিরণে। তারা কোন লাভ পাচ্ছেননা। আসল টাকাও দিচ্ছেনা।
বিকিরণের সাবেক মাঠ কর্মী মাহফুজার অভিযোগ করেন, ২০১৭ সালে তিনি বিকিরণে যোগদানের সময় নগদ ১৫ হাজার টাকা ও ব্যাংকের দু’টি চেকের পাতা জমা দেন। এক সময় বুঝতে পারেন তারা অবৈধ ব্যবসায় সহযোগিতা করছেন। তিনিসহ ৫ জন মাঠকর্মী চাকুরি ছেড়ে দেন। এরপরই তাদের উপর অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন হাফিজুর ও আদমের বিকিরণ। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের দুটি মামলা দেয়া হয়। যার একটির বাদী ভাড়াটে এক ব্যক্তি। যাকে তিনি কখনও চিনতেন না। একই অবস্থা চাকুরি ছেড়ে দেয়া মাঠকর্মী ইউনুছ, আনোয়ার, ইলিয়াস ও আব্দুর রশিদের।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাওলানা হাফিজুর রহমান জানান, তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। অনেক আগেই কোম্পানির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এ জন্য ১০ লাখ টাকা দিয়েছেন কোম্পানিকে। কাজেই তিনি কোন দায় দায়িত্ব নিতে নারাজ। তবে তিনি কোম্পানির স্বার্থে দাবী করেন, মাঠ পর্যায় থেকে টাকা উত্তোলন না হওয়ায় ও ব্যবসায় লোকসানের কারণে বর্তমানে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিকিরণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম আলী বলেন, ‘২০১৭ সালের বন্যা আর ২০২০ সালের করোনার শুরু থেকে ব্যবসায় লোকসান হয়। সেকারণে গ্রাাহকদের লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হয়নি। পাওনাদারের চাপে অফিস বন্ধ করে কয়েকমাস বাইরে ছিলাম। গ্রাহকদের কাছ থেকে সময় নিয়ে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।’