।। টেক ডেস্ক ।।
কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের মতো ডিজিটাল সামগ্রীকে ঘিরে এই জগত আমরা তৈরি করেছি, আমাদের চারপাশের ভৌত বাস্তব পৃথিবীতে নয়, এর অবস্থান এক সমান্তরাল ভার্চুয়াল বা অপার্থিব জগতে। যেখানে আছে আকাশের মতো সীমাহীন ইন্টারনেট, ফেসবুক ও টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া।
সেখানেই আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে: তাদের ছবি দেখছি, শুভেচ্ছা বিনিময় করছি, কথাবার্তা বলছি, এমনকি ওই জগতে নতুন নতুন বন্ধুও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে এত সব হচ্ছে? ভার্চুয়াল এই জগত পরিচালনা করার মূলে যা রয়েছে তা হচ্ছে গাণিতিক কিছু নির্দেশনা, কম্পিউটারের পরিভাষায় যাকে বলা হয় অ্যালগরিদম।
অ্যালগরিদম হচ্ছে যে কোনো কাজের প্রণালী বা ধাপে ধাপে কোন কিছু করার প্রক্রিয়া। রন্ধনপ্রণালীর সঙ্গে এর তুলনা দিয়ে এটি সহজে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
ভাত রান্না করার সময় প্রথমে একটি পাত্রে চাল নেওয়া হয়, তার পর তাতে পানি ঢালা হয়, চাল কয়েকবার ধোওয়ার পর সেটি রাখা হয় চুলার ওপরে, তার পর চুলা জ্বালাতে হয়- এই প্রক্রিয়াটিই অ্যালগরিদম।
এই বিষয় প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, “কম্পিউটারকেও একটি কাজ করার জন্য ওই কাজটিকে বিভিন্ন ধাপে ভাগ করে দেওয়া হয়, যাতে কম্পিউটার সেটা সহজে বুঝতে পারে এবং সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। কম্পিউটার নিজে কোন কাজ করতে পারে না। তবে তার রয়েছে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা। তাকে কিছু পদ্ধতি বলে দেওয়া হয় যাতে সে তার খুব কম বুদ্ধি দিয়ে (কিম্বা তার কোন বুদ্ধি নেই) কাজটা সম্পাদন করতে পারে। প্রক্রিয়াগুলো সূক্ষ্ম ও সরলভাবে দেওয়া থাকে যেন কাজটা সে কিছু গাণিতিক ধাপের মাধ্যমে শেষ করতে পারে। এসব নির্দেশনাই অ্যালগরিদম।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যালগরিদমের ব্যবহার নিয়ে সম্প্রতি অনেক আলোচনা হচ্ছে। কারণ এসব মিডিয়াতে মানুষ কোন খবর দেখতে পাবেন বা পাবেন না সেটা এই অ্যালগরিদমের মাধ্যমেই নির্ধারিত হচ্ছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রযুক্তিবিদ নাসিম মাহ্মুদ বলেন, “অ্যালগরিদম এখন অনেক দূর এগিয়েছে, অ্যালগরিদম অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেসব সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা চলছি। তিনি আরও বলেন, “ফেসবুকে অনেক সময় একজনের প্রোফাইল দেখিয়ে জানতে চাওয়া হয় – তিনি কি আপনার বন্ধু? এটা কীভাবে করা হয়? ফেসবুক কেমন করে বুঝলো যে এই ব্যক্তি আমার বন্ধু হতে পারেন? অনেক জটিল কিছু অ্যালগরিদম দিয়ে এই কাজটা করা হচ্ছে।”
কিন্তু এটা কি শুধু অ্যালগরিদমের নেওয়া সিদ্ধান্ত নাকি এর পেছনে মানুষেরও কোন ভূমিকা আছে?
তথ্য প্রযুক্তিবিদ নাসিম মাহ্মুদ বলছেন, যে ব্যক্তি অ্যালগরিদম ডিজাইন করছেন, তৎকালীন সময়ে তার জানা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই অ্যালগরিদম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ধরা যাক ফেসবুকে আপনার যিনি বন্ধু, তার বন্ধুরাও আপনার বন্ধু হতে পারে। অ্যালগরিদমকে বলা হলো একজন ব্যক্তির যে বন্ধু রয়েছে, তার যারা বন্ধু, তাদেরকে তুমি বলো যে তারাও তার বন্ধু হতে পারে। কিন্তু ধরা যাক যিনি অ্যালগরিদম ডিজাইন করেছেন তার হয়তো জানা ছিল না যে চাকরির সূত্রে, বা একই পাড়ায় থাকার কারণে, অথবা একই স্কুলে পড়ার কারণেও বন্ধু হতে পারে।”
“মানুষ যে বিষয়গুলো সহজে হিসাব করতে পারছে না অ্যালগরিদম সেই কাজটা দ্রুত করে দিতে পারছে। যেমন এক ব্যক্তি এক লক্ষ মানুষ থেকে তার বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারে না। কিন্তু অ্যালগরিদম মুহূর্তের মধ্যেই সেটা করতে পারছে।”
অ্যালগরিদমের নেটওয়ার্ক এখন এতো বেশি বিস্তৃত, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে গাণিতিক এসব নির্দেশনাই যেন মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে।
একজন ব্যক্তি কী করেন, কখন কোথায় থাকেন, কী খেতে পছন্দ করেন, তার সামাজিক মর্যাদা কী, তিনি কোন ফুটবল ক্লাবকে সমর্থন করেন- তার সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার থেকে অ্যালগরিদম এসব কিছু জেনে যায়।
ধরা যাক কেউ একজন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় হয়তো বললো যে তার বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। পরদিন দেখা গেল ফেসবুকে তাকে বিরিয়ানির বিজ্ঞাপন পাঠানো হচ্ছে এবং তিনি বিস্মিত হলেন যে তার কথা আড়ি পেতে শোনা হয়েছে কীনা! এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। একটি কারণ হতে পারে যে আড্ডায় উপস্থিত কোনো একজন বন্ধু হয়তো অনলাইনে বিরিয়ানি কিনেছেন। তখন অ্যালগরিদম হিসেব করে দেখেছে যে ওই বন্ধুর সঙ্গে তিনি গতকাল বিকেলে আড্ডা দিয়েছেন, হয়তো তারও বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে, এবং একারণেই তাকে বিরিয়ানির বিজ্ঞাপন পাঠানো হয়েছে।
ফেসবুকে কেউ যদি কোন থ্রিলার বই-এর খোঁজ করেন এর পর থেকে ফেসবুক তাকে থ্রিলার বই-এর খবর পাঠাতে থাকবে। এবং তিনি শুধু এধরনের বই-ই পড়তে থাকবেন। ভয়টা এখানেই- তিনি হয়তো জানতেও পারবেন না যে থ্রিলারের বাইরেও রোমান্টিক ও অ্যাডভেঞ্চার ধরনের বই রয়ে গেছে।
তবে সুখবর হচ্ছে যারা অ্যালগরিদমের ডিজাইন করছেন তারা এখন সোশাল মিডিয়াকে এধরনের বাবল বা বৃত্তের ভেতর থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছেন।
সূত্রঃ বিবিসি