।। নিউজ ডেস্ক ।।
একাত্তরে সংঘটিত নির্যাতন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে উলিপুর ও রাজারহাট থানার ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে আটক রয়েছেন ১১ জন, পলাতক দুইজন।
সোমবার (২৫ অক্টোবর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান সানাউল হক এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করা হবে। এটি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার ৮০তম প্রতিবেদন।
তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ১৯৭১ সালে উলিপুর ও রাজারহাট থানায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে ১৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে আটক রয়েছেন ১১ জন, পলাতক দুইজন।
আটক আসামিরা হলেন- মো. নুরুল ইসলাম ওরফে নুর ইসলাম (৭১), এছাহাক আলী ওরফে এছাহাক কাজী (৭৩), মো. ইসমাইল হোসেন (৭০), মো. ওছমান আলী (৭০), মো. আব্দুর রহমান (৬৫), মো. আব্দুর রহিম ওরফে রহিম মওলানা (৬৫), মো. শেখ মফিজুল হক (৮১), মকবুল হোসেন ওরফে দেওয়ানী মকবুল (৭২), মো. ছাইয়েদুর রহমান মিয়া ওরফে মো. সাইদুর রহমান (৬৪), মো. শাহজাহান আলী (৬৪) ও আব্দুল কাদের (৬৭)।
আসামিদের বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ মোট ১৬টি অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আনুমানিক ১০টার দিকে উলিপুর থানাধীন পাঁচপীর রেলস্টেশনে আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পের ইনচার্জ আ. হামিদ মওলানা ওরফে দাগ্গিল মওলানার (মৃত) নেতৃত্বে ১৫/১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার পিতা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জব্বার আনছারী ওরফে আনছারী মাস্টার ও নিরীহ পনির উদ্দিন মুন্সিকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যান। পরে স্টেশন ক্যাম্পে তাদের আটক রেখে রাতভর নির্যাতন করা হয়। পরদিন সন্ধ্যায় দুজনকেই গুলি করে হত্যার পর পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশনের পাশে মাটিচাপা দেয়া হয়।
অভিযোগ-২: ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ফজরের পর ডাগ্গিল মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার নুর ইসলামসহ ১৫/১৬ জন দুর্গাপুর গ্রামে হামলা করে ১০ জনকে আটক করেন। এর মধ্যে মাকরু শেখকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি আর্মি। বাকি সবাইকে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে তওবা করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টায় দাগ্গিল মওলানার নেতৃত্বে মফিজসহ ১৫/১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ৫/৬ জন পাক আর্মি নিয়ে উলিপুর থানার ঢেকিয়ারাম গ্রামে স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষদের ওপর হামলা চালান। পরে সেই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধার পিতা রজব আলী সরকারকে হাত ও চোখ বেঁধে অপহরণ ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার মরদেহ পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
অভিযোগ-৪: ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দাগ্গিল মওলানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাজী এছাহাক দলবল সহ ৫/৬ জন পাক আর্মি নিয়ে আওয়ামী লীগ করার কারণে উলিপুর থানার গোড়াই পাঁচপীর গ্রামের নশির উদ্দিনকে আটক করেন। পরে তাকে নিয়ে স্বাধীনতার সপক্ষের এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আ. জলিল সরকারের বাড়িতে গিয়ে জলিলকে না পেয়ে তার ছোট ভাই আব্দুল মজিদকে আটক করেন। গুলি করে হত্যার আগে তাকে দিয়েই কবর খুঁড়িয়েছিল রাজাকার বাহিনী।
অভিযোগ-৫: ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর দাগ্গিল মওলানার নেতৃত্বে ইসমাইলসহ ১৫/১৬ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ১০/১২ জন পাক আর্মি আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত গোড়াই পাঁচপীর গ্রামে হামলা করে। পরে সেই গ্রামের আকবর আলী সরকার ও আজিজার রহমানকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৬: ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর ওসমানসহ ১৫/১৬ জন রাজাকার পাক আর্মি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জহুর উদ্দিন ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে তাকে অপহরণের পর নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-৭: ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর রাজাকার আব্দুর রহমান পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফুলজার হোসেনকে আটক করেন এবং ফুলজারের পিতা হুসেন আলী ও মাতা গোজন বেওয়াকে নির্যাতন করেন। এ ছাড়া মোখছেদ আলীসহ ফুলজার হোসেনের দুই ভাইকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
অভিযোগ-৮: ১৯৭১ সালের ১০ কার্তিক মুক্তিযোদ্ধা আ. গফুর ও আমির উদ্দিন বাবা-মাকে দেখতে উলিপুরের লঘরটারি গ্রামে যান। গোপন এই সংবাদ পেয়ে দাগ্গিল মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার মো. আব্দুল বারী দলবলসহ ১০/১২ জন পাক আর্মিকে সঙ্গে নিয়ে লঘরটারী গ্রামে হামলা করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা আ. গফুর ও আজির উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করেন এবং তাদের আশ্রয়দাতা পনির উদ্দিনকেও মারপিট করে মারাত্মক আহত করেন।
অভিযোগ-৯: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রমজান মাসে অসুস্থ মাকে দেখতে মুক্তিযোদ্ধা মহব্বত আলী বাড়ি গিয়েছিলেন। তবে রাজাকারদের ভয়ে রাতের বেলা সিদ্ধান্ত মালতি বাড়ি গ্রামে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়েছিলেন। গোপন এই সংবাদ পেয়ে দাগ্গিল মওলানার নেতৃত্বে রাজাকার মফিজুল হক ও রহিম মাওলানা দলবলসহ ১০/১২ জন পাক আর্মি নিয়ে সিদ্ধান্ত মালতি বাড়ি গ্রামে হামলা করেন। পরে ওই গ্রামে রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়ের বাড়ি থেকে মহব্বত আলীকে নিরস্ত্র অবস্থায় আটক করে পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশন আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১০: মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার কারণে ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর দুপুরে রাজাকার মকবুল ১০/১২ জন পাক আর্মি নিয়ে মো. মফিজল হক ও তার চাচাতো ভাই নুরুল হোসেনের বাড়িঘর লুটপাট করে পুড়িয়ে দেন।
অভিযোগ-১১: ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রাম জেলার সদর থানায় অর্জুনডারা পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে গোলা ছুড়লে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। এই সময়ে পাক আর্মিরা ওসমান মিয়াকে গুলি করে হত্যা করে এবং হিন্দু পাড়ায় আগুন দেয়।
অভিযোগ-১২: ১৯৭১ সালে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে রাজাকাররা পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে বেশ কয়েটি গ্রামে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় মোছা. হাছিনা বেগমকে ধর্ষণ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১৩: ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর রাজাকার নুরুল ইসলাম, কাদের ও ইছাহাক কাজী ১০/১২ জন পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে যমুনা গ্রামে হামলা চালান। পরে সেই গ্রামসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে ফরহাদ, আছর উদ্দিন ব্যাপারীসহ ২০/২৫ জনকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-১৪: রাজাকাররা গোড়াই মিয়াজিপাড়া গ্রামে হামলা করে দছির উদ্দিনের বাড়িতে আগুন দেয় এবং নিরীহ তবির উদ্দিনকে হত্যা করে।
অভিযোগ-১৫: ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে রাজাকার ইছা খলিফা দলবল নিয়ে মফিজ উদ্দিন সরকারকে গুলি করে হত্যা করেন।
অভিযোগ-১৬: দছির উদ্দিন ব্যাপারীকে পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেয় রাজাকার বাহিনী।
সূত্রঃ নিউজ বাংলা২৪