।। জেলা প্রতিনিধি ।।
ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁ-তীরের ভাঙনে ফসলি জমি ও ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের ধনারচর নতুনগ্রামের বাসিন্দারা। গত এক বছরে এ গ্রামের শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, আবাদি জমি, ধর্মীয় স্থাপনাসহ ফৌজদারী-রাজীবপুর বেড়িবাঁধের এক কিলোমিটার সড়ক বিলীন হলেও ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অসাধু বালু ব্যবসায়ীদের অবৈধ ড্রেজারের অপরিকল্পিত খননে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠা এই নদের ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এর অববাহিকার শত শত পরিবার। গত তিন দিনে নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে ওই গ্রামের তিনটি পরিবারের বসতভিটা, আবাদি জমিসহ বেড়িবাঁধের একাংশ। এছাড়াও হুমকিতে রয়েছে ওই এলাকার অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি ও আবাদি জমি।
উপজেলা শহরের অদূরে সর্বগ্রাসী রূপে প্রবাহিত সর্ববৃহৎ এ নদের ভাঙনে অনেকগুলো পরিবারে হাহাকার শুরু হলেও সে খবর পাউবো কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায়নি। নদ অববাহিকার মানুষের বসতভিটা রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির নিষ্ক্রিয়তায় একের পর এক পরিবার সর্বস্বাস্ত হচ্ছে। আর পাউবো বলছে, খোঁজ নিয়ে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নতুনগ্রাম এলাকায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁ-তীরে অবস্থিত ধনারচর নতুনগ্রাম এলাকায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। অস্তিত্ব সংকটে পড়া পরিবারগুলো ভাঙন রোধে নিজেদের উদ্যোগে গাছপালা ও বাঁশ কেটে নদে ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও তা যেন তোয়াক্কাই করছে না সর্বগ্রাসী এ নদ। ভাঙন আতঙ্কে কেউ কেউ আবার ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে নদ থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে থাকা ধনারচর সিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ভাঙনের তীব্রতায় হতদরিদ্র পরিবারগুলোর দরিদ্রতা আরও প্রলম্বিত হলেও মুনাফা খেকো বালু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। অবৈধ ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দে নদ তীরবর্তী মানুষের দুঃখ আর হাহাকার যেন বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন তথ্য পাওয়া গেল ধনারচর নতুন গ্রামের প্রৌঢ় আব্দুর রহমানের জবানিতে। তিনি বলেন, গত তিন বছর থাইকা ভাঙতাছে। সরকারের পক্ষ থাইকা কোনও কিছুই করে নাই। পুরা গ্রামটাই উইঠা (ভাঙনে বিলীন) গেছে।
নদের জলসীমার অদূরে দেখিয়ে এই প্রবীণ বলেন, ওই দিক পর্যন্ত জমি আছিল। সব গ্যাছে। ওই দিক (ভাঙন রোধে) কয়টা বালুর বস্তা ফেলা ছাড়া আর কোনও কিছুই করে নাই।
অবৈধ ড্রেজার মেশিনে বালু ওঠানো হচ্ছেওই গ্রামের নওজ আলী, কমেলা বেগম, চাঁন মিয়া, নজু মিয়া, লাল মিয়াসহ ভাঙন হুমকিতে থাকা পরিবারগুলোর সদস্যরা জানান, গত বছরের মতো এবারও তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। তারা এখন পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবেন এ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই গ্রামবাসীদের অভিযোগ, প্রতি বছর নদের পাড় ঘেঁষে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। এতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের তীব্রতা বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে ভাঙন প্রবণতা।
এদিকে তাদের এ করুণ অবস্থায়ও খোঁজ নিতে আসেন না স্থানীয় কোনও জনপ্রতিনিধি। এমন অভিযোগ করে মাঝ বয়সী নারী কমেলা বলেন, ড্রেজার দিয়া আগত বালা তুলছে। সেজন্যে ধার (স্রোত) এই দিক চাপছে। ভাঙনে অনেকগুলা বাড়ি গেইলেও (বিলীন হলেও) চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ খোঁজ নিবার আহে নাই।থ ভুক্তভোগীদের দাবি, এখনই ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে কয়েকদিনের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পুরো গ্রাম।
জানতে চাইলে যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরবেশ আলী বলেন, ওই এলাকায় এখনও যাওয়া হয়নি। তবে ইউএনও স্যারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল ইমরান বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জরুরি ভিত্তিতে ওই এলাকায় জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার শৌলমারী ইউনিয়নে কিছ অংশে জিও ব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এটা (যাদুরচর ইউনিয়নের ভাঙনের ব্যাপারে) আমরা খবর নেবো। যদি তেমন কিছু হয় তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবো।
প্রসঙ্গত, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলার ভাঙনে জেলা জুড়ে শত শত পরিবার বাস্তুহারা হচ্ছে। প্রতি বছর ভাঙনের শিকার হয়ে জেলায় উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নদ-নদীময় কুড়িগ্রামের নদী তীরবর্তী এলাকায় চলছে এসব পরিবারের চাপা কান্না।
//নিউজ/কুড়িগ্রাম//সুভাষ/জুলাই/১৭/২১