।। নিউজ ডেস্ক ।।
প্রায় ছয় দশক সময় পার করে এসে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেতে যাচ্ছে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী নদীবন্দর। ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া এ নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের এ সভায় সংযুক্ত হন। এর আগে ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিলমারীকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং অন্যান্য নদী ও সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এর সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে জোর দেন। সে অনুসারে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন হলে ও চুক্তি অনুসারে নৌ-চলাচল শুরু করলে ৫৯ বছর পর চালু হবে আসাম-নেপাল-ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌ-চলাচল।
ব্রহ্মপুত্র নদের উপকূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা চিলমারী নদীবন্দরে একসময় ভিড়ত বড় বড় নৌকা ও জাহাজ। মালপত্র খালাস করা হতো, আবার জাহাজে নতুন করে মালপত্র ভরে পাড়ি জমাত অন্য বন্দরে। ব্রিটিশ আমলে আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিলমারী বন্দর। কয়েক দশক ধরেই বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হওয়া এ নৌপথ রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায় ১৯৬৫ সালে।
বন্দরটি চালু থাকাকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো যমুনা নদীকে। কুড়িগ্রামের চিলমারী হয়ে বাহাদুরাবাদ, সিরাজগঞ্জ থেকে দুদিকে চলে যেত নৌপথটি। একটি নৌপথ গড়াই নদী হয়ে ও অন্যটি চাঁদপুর ও বরিশাল হয়ে ভারতের দুটি বন্দরে যেত। ফলে দেশে একটি শক্তিশালী নৌ-রুট চালু ছিল। কিন্তু চিলমারী বন্দরটি বন্ধ হওয়ার পর থেকেই দেশের নৌ-রুট তার জৌলুস হারাতে শুরু করে।
দীর্ঘ সময় পর এবার চিলমারী বন্দর চালুর উদ্যোগ নিল সরকার। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার রমনা ও জোড়গাছ ঘাট এলাকা, রাজিবপুর উপজেলার রাজিবপুর ঘাট ও নয়ারহাট ঘাট এলাকা এবং রৌমারী উপজেলার রৌমারী ঘাট এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। রংপুর বিভাগের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার কিছু এলাকার নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে চিলমারী এলাকায় বন্দর অবকাঠামো সুবিধাদি নির্মাণ করা হবে।
বন্দরটি চালু হলে চিলমারী এলাকায় বছরে পরিবাহিত প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার যাত্রী ও দেড় লাখ টন মালপত্রের সুষ্ঠু ও নিরাপদ ওঠানামা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নৌ-বাণিজ্য ও অতিক্রমণ প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তনে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশভাগের কারণে ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে এ বন্দর। আমরা আধুনিক মানের বন্দর স্থাপনে এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দিয়েছি। অনুমোদনের সময় বন্দর নিয়ে প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীনের গানের প্রথম লাইনটি পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী। বন্দরটি চালুর বিষয়ে আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে ৩৩ লাখ ঘনমিটার, তীর রক্ষা ৭৮৫ মিটার, স্টিল জেটি নির্মাণ ৩৭৯ দশমিক শূন্য ৮ বর্গমিটার, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ ১০৯ দশমিক ৯০ বর্গমিটার, অভ্যন্তরীণ পোর্ট রোড ৩ হাজার ৯৪ বর্গমিটার, আরসিসি পেভমেন্ট ইন্টারনাল পোর্ট রোডসহ ১০ হাজার বর্গমিটার, আরসিসি জেটি অ্যান্ড এক্সেস ব্রিজ ২ হাজার ৪৮০ বর্গমিটার, সিডিসহ র্যাম্প ৪৫৯ বর্গমিটার, স্টিল স্পাড ৩৯টি ও পন্টুন পাঁচটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চিলমারী এলাকায় একটি আধুনিক নদীবন্দর স্থাপিত হবে। এছাড়া আন্তঃদেশীয় নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রকল্পটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলে ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে চিলমারী বন্দর ও নৌপথটি। কেননা নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ সড়কপথের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। আবার নৌপথে পণ্য পরিবহন করলে পরিবেশ রক্ষা ছাড়াও পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখা সম্ভব হয়। এছাড়া নদীর দুইপারে শিল্প ও নৌপথের উন্নয়ন হলে জ্বালানি সাশ্রয়ী পণ্য পরিবহন, প্রবৃদ্ধিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দেশের সবুজ অর্থনীতি আরো বেগবান হবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ১ হাজার ৭৮৬ বর্গমিটার এলাকায় টার্মিনাল ভবন স্থাপন, ২৪৬ বর্গমিটার আয়তনের যাত্রী বিশ্রামাগার, ১ হাজার ৩০৪ বর্গমিটারের ওয়্যার হাউজ, ৫৯৫ বর্গমিটার পরিদর্শন বাংলো, ১ হাজার ৪৫৩ বর্গমিটারের একটি করে স্টাফ ও অফিসার্স ডরমিটরি, ৩৫৮ বর্গমিটারের একটি করে আনসার ও ফায়ার সার্ভিস ব্যারাক, ছয় হাজার বর্গমিটারের পার্কিং ইয়ার্ড, ২ হাজার ৪০০ বর্গমিটারের সীমানা প্রাচীর ও বারবেড ওয়্যার এবং আসবাব ও অফিস সরঞ্জাম ইত্যাদিসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে।
একনেকে ১০ প্রকল্প অনুমোদন: জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ৬ হাজার ৬৫১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়সংবলিত ১০টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের এ সভায় সংযুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে বেশি সাইলো নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া জাত উন্নয়ন ও শস্যের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য টিস্যু কালচারের প্রতিও জোর দিতে বলেছেন তিনি। স্লুইস গেট নির্মাণে আরো সতর্ক হওয়া ও পানি প্রবাহিত খাল সংরক্ষণে জোর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের ফাউন্ডেশন কোর্স ন্যূনতম ১০ মাস করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এ আমলাতন্ত্রের বিকল্প নেই জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ফেরাউনের আমলেও আমলা ছিল, খলিফাদের আমলেও সেটি ছিল। ফলে এ আমলাদের দক্ষতা বাড়িয়েই দেশের উন্নয়ন বেগবান করতে হবে।
গতকালের একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলো বরিশাল (দিনেরারপুল) লক্ষ্মীপাশা-দুমকি সড়ক (জেড-৮০৪৪)-এর ২৭তম কিমি এ পাণ্ডব-পায়রা নদীর ওপর নলুয়া-বাহেরচর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, মধুপুর-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক (এন-৪০১) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প। বিপিএটিসির প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধীকরণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্সের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম-হাটপাঁচিল ও তত্সংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ এবং বেতিল স্পার-১ ও এনায়েতপুর স্পার-২ শক্তিশালীকরণ কাজ প্রকল্প, ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙ্গন ব্যারেজ, বুড়ি বাঁধ ও ভুল্লি বাঁধ সেচ প্রকল্পগুলো পুনর্বাসন, নদীতীর সংরক্ষণ ও সম্মিলিত পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের জীব প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিবীজ উন্নয়ন ও বর্ধিতকরণ প্রকল্প, দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান শুকানো, সংরক্ষণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ আধুনিক ধানের সাইলো নির্মাণ (প্রথম ৩০টি সাইলো নির্মাণ পাইলট প্রকল্প) প্রকল্প ও বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প।
সূত্রঃ valosangbad