।। জেলা প্রতিনিধি ।।
রৌমারী উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে সরকারি অর্থে মডেল মসজিদ নিমার্ণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদার স্থানীয় মন্ত্রীর ভাই হওয়ার সুবাদে মসজিদ নির্মান কাজে নির্বিঘ্নে নিম্নমানের ইট, বালু, সিমেন্ট ও রড ব্যাবহার করছে, এছাড়াও বিশেষ ঢালাইয়ের সময় পরিমাণে কম সিমেন্ট ব্যবহার , অত্যন্ত কৌশলে পুরাতন ইট ও রড ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। মসজিদের ঢালাইয়ের কাজে স্টীলের স্যাটারিং ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও সেখানে কাঠের সাটারিং ব্যবহার করায় কাজের ফিনিশিং ও গুনগত মান খারাপ হচ্ছে। পিলারে ২০ মিলি ডি-ফর্মরড ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও কম মিলির রড ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের প্রভাব খাটিয়ে তার ভাই এসব গুরুতর অনিয়ম করছে বলে স্থানীয় একাধীক মানুষ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন।
মসজিদ নিমার্ণ কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ভাবে মানুষ জন কানাঘুষা করলেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ক এ্যাসি¯ট্যান্ট ও উপসহকারি প্রকৌশলী বার বার নিষেধ করলে ঠিকাদার মোস্তাফিজুর রহমান রবিন তাদের কথা আমলেই নিচ্ছেন না বলে জানা গেছে। কাজের শুরু থেকে ঢিলেঢালা ভাবে নিমার্ণ কাজ চললেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে যথাসময়ে কাজ সমাপ্ত করার তাগিদপত্র দিলেও আমলে নিচ্ছেন না ঠিকাদার-এমন তথ্য জানিয়েছেন উপসহকারি প্রকৌশলী।
কুড়িগ্রাম গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নিমার্ণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ একটি উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে রৌমারী উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর এলাকায় তিনতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নিমার্নে প্রায় ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। মসজিদ নিমার্ণের দায়িত্ব পান প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান রবিন। গত ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে নিমার্ণ কাজ শুরু হয় যার সময়সীমা ছিল ২৪ মাস।
নিমার্নাধীন মসজিদে এখনো প্রাথমিক স্তরের কাজ চলছে। মসজিদের পিলার ও গম্বুজের কাজ করার দৃশ্য দেখা গেছে। এসময় নিমার্ণ শ্রমিকদের কাছে কাজের মান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেউ বলার আগ্রহ দেখায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক বলেন, মসজিদের কাজের মান খুবই খারাব করা হচ্ছে। বেজ ঢালাইয়ে পাথরের খোয়া ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও সেখানে ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। নিম্নমানের বালু ও কমগ্রেডের সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েকটি জায়গায় পুরাতন ইট, পুরাতন প্লেনরড ঢুকানো হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে ২.৫ এফএম বালু ব্যবহারের কথা সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ধুলা মিশ্রিত বালু। সিমেন্টের ব্যবহার পরিমান মতো দেয়া হচ্ছে না। ইট ও পাথরের খোয়া ভালো ভাবে পরিস্কার না করে ময়লাযুক্ত অবস্থায় ঢালাইয়ের কাজে লাগানো হচ্ছে। আমরা কামলা দেই। ঠিকাদার যে ভাবে কাজ করতে বলেন সে ভাবেই আমাদের করতে হয়।
নিমার্ণ শ্রমিকরা জানিয়েছেন সাইট অডার্র বা পরিদর্শন বইতে প্রকৌশলী লিখে গেছেন, নিম্নমানের বালু, পুরাতন ও প্লেনরড সরাতে হবে। পিলার থেকে রড খুলতেও বাধ্য করা হয়েছে। কাঠের পরিবর্তে স্টীলের সাটারিং ব্যবহারের নির্দেশও ওই পরিদর্শন বইতে লেখা রয়েছে। মসজিদের প্রতিটি কলমে ২০ মিলি রড ব্যাবহারের কথা থাকলেও ঠিকদার দুটি করে ২০ মিলি রড দিয়ে বাকী গুলো ১৬ মিলি রড দিয়ে কলম ঢালাই করছে।
উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের জামে মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন স্থানীয় একজন মুসুল্লি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব উপজেলায় মডেল মসজিদ নিমার্ণের উদ্যোগ নিয়ে শেখের বেটি ইসলাম ধর্মের প্রতি তার আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই মহোৎ উদ্যোগকে কলঙ্কিত করছেন সরকারি দলের কতিপয় অর্থলিপ্সু লোক। আমাদের এই মসজিদ নিমার্ণের শুরুতে পুরাতন ইট ও রড ব্যবহার করা হয়েছে বলে মানুষের কাছে শুনেছি। বিষয়টি উপজেলা সদরে ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিমার্নাধীন মসজিদের ৫০ গজ দূরেই উপজেলা পরিষদের পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তুলে নিয়েছে ওই ঠিকাদার। এর ফলে নিমার্নাধীন মসজিদটি শুরুতেই হুমকির মুখে । হুমকির আশংকা করা হচ্ছে চারতলা ভবন উপজেলা পরিষদ ভবনও। ঠিকাদার প্রতিমন্ত্রীর ভাই হওয়ার কারনে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাও কিছু বলতে পারেন না বলে জানালেন অনেকে।
উপজেলা পরিষদের পুকুরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা আল ইমরান বলেন, নিমার্ণধীন মসজিদে মাটি ভরাটের জন্য কিছুদিন বালু তোলার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আমরাও পুকুরটা খনন করতে চেয়েছি। এতে নিমার্ণাধীন ভবন ও উপজেলা পরিষদ ভবন হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঠিকাদার মোস্তাফিজুর রহমান রবিন নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কথা অস্বীকার করে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী নিমার্ণ সামগ্রী ব্যবহার করছি। যদি কেউ বলে থাকে তাহলে মিথ্যা বলেছে। প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, মডেল মসজিদ নিমার্ণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব একটি উদ্যোগ। এখানে কোনো ধরণের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। সে আমার ভাই হোক আর অন্য কেউ হোক। আমি গণপূর্ত অধিদপ্তরের লোককে বলেছি তারা যেন সঠিক কাজ বুজে নেন।
এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম গণপূর্ত অধিদপ্তরের নিবার্হী প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোশারফ হোসেন বলেন, কোনো ধরণের অনিয়ম আমরা মেনে নিব না। আপনারা হয়তো জানেন ডি-ফর্ম ব্যতিত অন্য সব রড পিলার থেকে খুলে নিতে বাধ্য করেছি ওই ঠিকদারকে। নিম্নমানের বালু সরিয়ে নিতে বলেছি। ধীরগতির কাজ করায় ঠিকাদারকে একাধিকবার তাগাদাপত্র দিয়েছি।
//নিউজ/কুড়িগ্রাম//সুভাষ/মে/০৩/২১