।। জেলা প্রতিনিধি ।।
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানের নামে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন ও ক্রসফায়ারে দেয়ার চেষ্টার ঘটনায় জড়িত কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন ও তিন নির্বাহী মেজিস্ট্রেটসহ জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় সাংবাদিক ও সুধীজন। রবিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে কুড়িগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে আয়োজিত ঘন্টাব্যাপী এক মানববন্ধনে এই দাবি জানান বক্তারা।
কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে গতবছর ১৪ মার্চ গভীর রাতে সাংবাদিক আরিফকে তার নিজ বাসা থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। পরে তাকে ক্রস ফায়ারে দেওয়ার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্রস ফায়ার থেকে ফিরিয়ে নিলেও জেলা প্রষাসকের কার্যালয়ে নিয়ে তাকে বিবস্ত্র করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে মাদক রাখার মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়। আজ সেই ভয়াল নির্মমতার এক বছর।
স্থানীয় সংবাদকর্মী ও সুধীজনদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধনে বক্তরা এক বছরে মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়া এবং তদন্ত প্রতিবেদন জমা না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক দাবি করেন তারা।
বক্তারা বলেন, ‘আরিফুলকে হত্যাচেষ্টার জঘন্য কর্মে সে সময়ের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন ম্যাজিস্ট্রেট জড়িত থাকায় সাগর-রুনির মামলার মত এ মামলাটিও প্রভাবিত হচ্ছে।’ দ্রুত মামলার প্রতিবেদন জমা নিয়ে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা না করলে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার হুশিয়ারি দেন বক্তারা।
বার্তা বাজার পত্রিকার কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সুজন মোহন্তের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন গণকমিটির সদস্য মামুনুর রশিদ, রাস্ট্রচিন্তার সদস্য দিল্লুর রহমান, সাংবাদিক রাশেদুল ইসলাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক দুলাল বোস, সাংবাদিক রাজু মোস্তাফিজ, হাসিবুর রহমান হাসিব, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক শ্যামল ভৌমিক, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব প্রমূখ।
প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে জেলা প্রশাসনের একটি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করার জেরে গত বছরের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে তার নিজ বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। এরপর তাকে এনকাউন্টারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে জেলা শহরের ধরলা ব্রিজের পূর্ব পারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিবস্ত্র করে নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন ওই সময়ের আরডিসি নাজিম উদ্দীন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা। পরে সাংবাদিক আরিফের কাছে আধা বোতল মদ ও দেড়শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে, মধ্যরাতে বাড়ি থেকে একজন সাংবাদিককে ধরে এনে সাজা দেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হলে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মুহূর্তে দেশজুড়ে মানববন্ধনে নামে সাংবাদিক সমাজসহ সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতি সংগঠন। সরকারি দলের নেতারা থেকে বিরোধীদলের নেতা–সবাই এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। উদ্যোগী হয় সরকারও। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় পরদিন (১৫ মার্চ) ঘটনাস্থলে যান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যার তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে।
ঘটনাটি জনমনে এতটাই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে যে ঘটনার একদিন পর ১৫ মার্চ পরিবারের আবেদন ছাড়াই আরিফকে জামিনের ব্যবস্থা করে জেলা প্রশাসন। কারামুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরডিসি নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামসহ অজ্ঞাত ৩৫/ ৪০ জনের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম সদর থানায় এজাহার দায়ের করেন সাংবাদিক আরিফ। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ৩১ মার্চ সেই মামলা রেকর্ড করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ। মামলার নম্বর-২৪, জি আর নম্বর-৮৩/২০২০ (কুড়ি)।
এদিকে, সম্প্রতি আপিল বিভাগে মামলাটি বাতিল চেয়ে আরডিসি নাজিম উদ্দিন আবেদন জানালেও শুনানিতে তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে উচ্চ আদালত। সেখানে ফৌজদারি মামলাটি চলবে বলে আদালত নির্দেশ দেয়।
//নিউজ/কুড়িগ্রাম//চন্দন/মার্চ/১৪/২১