।। জেলা প্রতিনিধি ।।
কুড়িগ্রামে কৃষির উপর নির্ভরশীল অসংখ্য পরিবার এবারে ৫ দফা বন্যায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীণ হন। এ ক্ষতি সামাল দিতে ইতিমধ্যে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বেড়িয়ে পরেছে কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পাশাপাশি নারীরাও কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে বিকল্প চাষাবাদে। অভাব অনটনের সংসারে চাহিদা মেটাতে গৃহিনীরা এখন কৃষাণীর পেষাকে অনেকেই বেছে নিয়েছে।
বুধবার (৩০ডিসেম্বর) সরেজমিন কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের সুভারকুটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, মাঠে কৃষাণীদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। ৫ দফা বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান ক্ষেতে কেউ লাগিয়েছে শশা, কেউ সিম, কেউ কুল বড়ই, পেঁপেসহ নানান জাতের সবজি। সেপ্টেম্বরে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর মাত্র ২৫ শতক জমিতে শশা লাগিয়েছিলেন কৃষাণী মেঘনা বেগম। তিন মাসে শশা বিক্রি যোগ্য হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তিনি ২ হাজার ৮শত টাকার শশা বিক্রি করেছেন বলে জানান । আরো বেশ কিছু বিক্রির জন্য রয়েছে। এ সবজি চাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তার আশা ১ লক্ষের অধিক টাকার শশা বিক্রি করতে পারবেন।
তারই প্রতিবেশী আমিনা বেগম জানালেন, বন্যায় স্বামীর বাড়িভিটা ভেঙে যাওয়ায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বিভিন্নভাবে ঋণ করে বাবার ৬০শতক জমিতে আপেল কুল, পেঁপে, মরিচ ও বেগুন লাগিয়েছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। স্বামীর ৩০শতক জমিও বন্ধক রাখতে হয়েছে তাদেরকে। এবার ধানচাষ করে অনেক টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে তাকে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার বিকল্প চাষবাস করে নিজের মাথা গোঁজার জন্য জমি কেনার স্বপ্ন দেখছে সে। এই সংকটময় সময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ। নারী কৃষাণিদের সহযোগিতায় তারা ১৩ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণসহ ২ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি পূণর্বাসনের অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। এর সাথে অন্যান্য ঋণ করে ভাগ্য বদলাতে চাইছেন তারা।
এই গ্রামের ইতি বেগম জানান, এই এলাকায় কখনো বন্যা হতো না। গত ২০১৭ সাল থেকে বন্যা হচ্ছে। এবার ৫ দফা বন্যায় তিনবার বীজতলা ও ধানক্ষেত বিনষ্ট হয়েছে। এতে লোকসান হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আরডিআরএস থেকে পূণর্বাসনের জন্য প্রায় ১২হাজার টাকা পেয়েছেন। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ দিয়ে ৩০শতক জমিতে সিম লাগিয়েছেন। সিম বিক্রি করে লোকসান পুরণ করতে চাইছেন এই কৃষাণি।
হলোখানা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার গোলজার হোসেন জানান, দিন বদলে গেছে। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন শুধু ঘরের কাজ নয, স্বামীর সাথে কৃষিকাজেও হাত লাগাচ্ছে। আবাদ কিস্তি কিভাবে করতে হয় তাও শিখেছে তারা। ফলে এখন পুরুষবা জমি তৈরী করে অন্য জেলায় চলে যান কাজের আশায়। আর বউ-ঝিরা কোমড় বেঁধে মাঠে কৃষি কাজ করছে ।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের শুধু সুভারকুটি গ্রাম নয়। বন্যা কবলিত কুড়িগ্রামের পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন ও রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের কৃষাণিরা এখন বিকল্পচাষাবাদ করে ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন দেখছেন।
উলিপুরের বজরা ইউনিয়নের খামার বজরা মুন্সিপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী হাসিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটেছে একটি সেলাই মেশিন কিনে। বিভিন্নভাবে প্রকল্প থেকে প্রায় ২২ হাজার টাকা পেয়ে সেলাই মেশিন কিনেছে সে। সেটা দিয়েই ভাগ্য বদলাতে চেষ্টা করছেন তিনি। তার এই কর্মকান্ডে খুশি এলাকার মানুষ।
পার্শ্ববর্তী কালপানি বজরা ব্যাপারী পাড়া গ্রামের শিউলী বেগম ২০১৮ সালে পূণর্বাসনের জন্য ১১ হাজার ৬ শত টাকা। তার সাথে নিজের কিছু অর্থ যোগ করে একটি বাছুর কিনেছিল। এখন তার ঘরে ৩টি গরু ও একটি বাছুর রয়েছে। গাভীটি দুধ দিচ্ছে। তা বিক্রি করে পরিবারে সহযোগিতা করছে সে।
বাস্তবায়নকারি সংস্থা আরডিআরএস এর প্রকল্প সমন্বয়কারী তপন কুমার সাহা জানান, আর্থিক অন্তর্ভূক্তি ও উন্নতি করণের মাধ্যমে নারী ও যুবাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী, যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বজরা এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ১৩ হাজার নারী ও যুবাদের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষমতায়নে কাজ করা হচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ট্রিকেলাপ ও মেডলাইট ফাউন্ডেশন। এতে কারিগরি সহযোগিতা করছে কনসার্ন ওয়াল্ড ওয়াইড।
হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমর ফারুক জানান, সমাজে বেকার বসে থাকা নারী ও যুবাদের এই কর্মকান্ডে যুক্ত করার ফলে তারা নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। কিছু নারী ও যুবা এই কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদলে সফলতা দেখিয়েছে।
//নিউজ/কুড়িগ্রাম//সুভাষ/ডিসেম্বর/৩১/২০