|| জেলা প্রতিনিধি ||
ঘুম থেকে জেগে বিছানা ছাড়ার আগেই বসত ভিটার মাটি নদীগর্ভে পড়ার শব্দে ছোটাছুটি শুরু হয় সালেহা বেগমের। ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে নিতে তিনটি ঘর আর হাঁস-মুরগি ভেসে যায় ধরলার স্রোতে। সর্বস্ব হারিয়ে বিধবা সালেহা এখন আশ্রয়ের জন্য অন্যের জমি খুঁজছেন। সালেহার মতো প্রতিনিয়ত নদী ভাঙনে বাস্তুহারা হচ্ছেন কুড়িগ্রামের তিস্তা,ধরলা, দুধকুমার আর ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার শত শত পরিবার। কয়েক মাস ধরে চলমান নদী ভাঙনে কয়েক হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হলেও তাদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনও সহায়তা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবার ও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা সূত্রে জানা গেছে, জেলার ছয় উপজেলায় (সদর, রৌমারী, রাজীবপুর, চিলমারী, উলিপুর ও নাগেশ্বরী) নদী ভাঙনে ভিটেহারা প্রায় ৪ হাজার ৫৬টি পরিবারের তালিকা করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হলেও এখনও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে পাঠানো তালিকায় বেশিরভাগই বিগত বছরে নদী ভাঙনের শিকার। চলতি বছর ভাঙন চলমান থাকায় এবং নতুন নতুন এলাকা ভাঙন কবলিত হওয়ায় পরবর্তীতে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা পাঠানো হবে।
জেলার সদর উপজেলার ভোগডাঙা ইউনিয়নে ধরলার ভাঙনে বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকালে জগমনের চর এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগমসহ ওই এলাকার ১৫ টি পরিবার গৃহহারা হয়েছেন। ভাঙন অব্যাহত থাকায় হুমকিতে রয়েছে আরও অর্ধশত পরিবার।
ভাঙনে ভিটেহারা জগমনের চরের বাসিন্দা ছক্কুর আলী বলেন,‘ মোর ছয়টা ঘর নদীত ভাঙি গেইছে, এলা বাঁধত ঘর তুলবার নাগছি। কী করমো, পরিবার নিয়া বাঁচি থাকাতো নাগবে। কাইয়ো এখনা সাহায্যও করেনা! ’
ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জানান, গত দুই দিন থেকে তার এলাকায় ধরলার ভাঙনে অনেক পরিবার ভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এখনও অনেক পরিবার ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও ভাঙন প্রতিরোধ কিংবা ভিটেহারা মানুষদের পুনর্বাসনে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
জেলার নদ-নদী অববাহিকা অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়তে শুরু করায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। জেলার সদর উপজেলায় ধরলা, নাগেশ্বরীতে দুধকুমার, রৌমারী ও রাজীবপুরে ব্রহ্মপুত্র এবং উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলায় তিস্তার ভাঙনে ফসলি জমি হারানোর পাশাপাশি বসতভিটা হারাচ্ছেন নদী অববাহিকার বাসিন্দারা। গত কয়েক সপ্তাহে তিস্তার ভাঙনে উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া, বজরা ও থেতরাই ইউনিয়নে পাকা সড়ক, ফসলি জমি ও মসজিদসহ ভিটেমাটি হারিয়েছেন শতাধিক পরিবার। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে আরও শতাধিক পরিবারসহ সড়ক ও ফসলি জমি।
বজরা ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো জানায়, পরপর দুই দফা ভাঙনে ইউনিয়নের ৬,৭ ও ৯ নং ওয়ার্ডের শতাধিক পরিবার ভিটে হারিয়ে বাস্তুহারা হয়েছে। অনেকে স্থানীয় টি বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে তাদের পুনর্বাসনে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অব্যাহত ভাঙনে বসতভিটা, মসজিদ, পাকা সড়ক ও ফসলি জমিসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনও কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমিন জানান, তার ইউনিয়নে তিস্তা সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। চলতি ভাঙনে ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের চর বজরা পূর্বপাড়া হাঁস খাওয়া ব্রিজ সংলগ্ন প্রায় ২৫ টি পরিবার গৃহহারা হয়েছে। ওই এলাকায় চর বজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও অনেক বসতি ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।
রেজাউল করিম আমিন বলেন, ‘মাসখানেক আগে তিস্তার ভাঙনে ৯ নং ওয়ার্ডের চর বজরায় শতাধিক পরিবার ভিটে হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে এখন স্থানীয় টি বাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছে। গত দুই দিনে তিস্তার ভাঙনে আরও ২৫ টি পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। দু’দফা ভাঙনের শিকার হলেও ভুক্তভোগীদের কিছু ত্রাণের চাল দেওয়া ছাড়া পুনর্বাসনে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি ভাঙন প্রতিরোধে কয়েকটি জিও ব্যাগ ফেলা ছাড়া কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
এদিকে দুধকুমার নদের পানি বৃদ্ধির সাথে ভাঙনের তীব্রতায় জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নে অন্তত অর্ধশত পরিবার বাস্তুহারা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বারেক মিয়া, মামুন ও আল মদিনা জানান, কয়েকদিন ধরে দুধকুমার নদের ভাঙন প্রবণতা বেড়েছে। গত এক মাসে তাদের গ্রামে অন্তত ১৩টি পরিবার গৃহহারা হয়েছে। নদের পূর্বপারে বামনডাঙা আবাসন এলাকায় ভাঙনে গৃহহারা অনেক পরিবার পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি করে দিনানিপাত করছে।
রায়গঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্যাহ আল ওয়ালিদ জানান, নদী ভাঙনে এলাকার অবস্থা সংকটাপন্ন। চলতি ভাঙনে ইউনিয়নে অন্তত ১৭ থেকে ২০ টি পরিবার একেবারে বাস্তুহারা হয়েছে। এরা কেউ সড়কে আবার কেউ অপরের জমিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এসব পরিবারকে খাদ্য সহায়তা ছাড়া তাদের পুনর্বাসনে কোনও সহায়তা করা সম্ভব হয়নি। তবে উপজেলা প্রশাসনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের তালিকা পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘ ভাঙন কবলিত এলাকায় খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। প্রতি ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ভুক্তভোগীদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন প্রশ্নে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘ আমরা চলতি মাসে গৃহহারাদের তালিকা করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছি। আশা করছি খুব শিঘ্রই বরাদ্দ পাওয়া যাবে। বরাদ্দ পেলে সংশ্লিষ্টদের গৃহ নির্মাণ ও পুনর্বাসনে সহায়তা করা হবে।’