|| সুজানাহ সাভাজ ||
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় হেলিকপ্টার থেকে নামার পরই বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানকে স্বাগত জানায় স্বাস্থ্যকর্মীদের ছোট একটি দল। বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান সিলেটের সাবেক মেয়র ও ক্ষমতাসীন দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ঢাকায় অবতরণের পরই দ্রুত তাকে দেশের প্রিমিয়ার স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা থাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএইমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনই এই ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার আশা করতে পারেন। আর মাত্র কয়েক মাইল দূরেই সবচেয়ে কম সৌভাগ্যবানদের চিকিৎসার জন্য গরমের মধ্যে ফুটপাতে বসে থাকতে দেখা যায়।
মহামারির আঘাত ১৭ কোটি জনসংখ্যার ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাটলগুলো যেন স্পষ্ট করে দিয়েছে। লকডাউন ও অপর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের কারণে কয়েক লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
গত সপ্তাহেই নাগরিকদের আবারও কাজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও দিনদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসছে দাতব্য সংস্থা ও সচেতন নাগরিকরা।
বাংলাদেশ জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইরে অবস্থানের সময় মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হটস্পটগুলোতে স্থানীয়ভাবে লকডাউন চালুর পরিকল্পনার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৫২। মারা গেছেন ১ হাজার ৪৯ জন।
এই মাসের শেষ দিকে সংখ্যাটি ১ লাখ ২৩ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।
দেশটিতে করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষাও কম। বাংলাদেশি জনস্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা এমিনেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. শামীম তালুকদার জানান, প্রতিদিন মাত্র ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। এর বাইরে কোভিড-১৯ পরীক্ষা জন্য অনুমোদিত হাসপাতালের বাইরে আরও কয়েক হাজার মানুষের লাইন রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় প্রতি পাঁচজনের নমুনা সংগ্রহ করলে গড়ে এক জনের কোভিড পজিটিভ পাওয়া যায়।’
‘ঢাকার বাইরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার মান এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।’ ডা. তালুকদার বলেন, ‘আমাদের সঠিক প্রশিক্ষণ নেই। প্রচুর ফলস নেগেটিভ আসছে।’
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সঠিকভাবে পরীক্ষা করতে পারলে সরকারি তালিকায় মৃতের সংখ্যাও বাড়বে।
দেশটিতে করোনায় মৃতের প্রকৃত তথ্য জানা বেশ কঠিন।
ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক জানান, স্বাভাবিক সময়ের চাইতে গত দুই মাসে প্রায় দ্বিগুণ কবর খনন করা হয়েছে।
কবর দেওয়ার সময় প্রায় ৫০ জনের মৃতদেহের মধ্যে কয়েকজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
আগে বনানী কবরস্থানে দিনে একটি বা দুইটি মরদেহ কবর দেওয়া হলেও গত মাস থেকে প্রতিদিন এখানে গড়ে পাঁচটির মতো কবর দেওয়া হয়।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থান। সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক জানান, মে মাসের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জন কোভিড রোগীকে সেখানে কবর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, কোভিডে মারা যাননি এমন মৃতদেহের সংখ্যা আগের তুলনায় এখন দিনে গড়ে প্রায় ১০টি বেড়েছে।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরেও ধাক্কা আসতে শুরু করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন জানান, স্বাস্থ্যসেবা খাতে দেশটিতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় জিডিপির এক শতাংশেরও কম।
তিনি বলেন, ‘এখানে একটা ফাঁকা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। চকচকে হাসপাতাল কখনো কখনো সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের ভবনের মতো দেখালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভেতরে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী।’
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অকার্যকর অবস্থা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) চেয়ারম্যান ডা. শাহেদ রাফি পাভেল।
তিনি জানান, দেশে মাত্র কয়েক হাজার ভেন্টিলেটর রয়েছে। আইসিইউ বেডের ঘাটতি আছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ঢাকার ২১৮ টি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের মধ্যে কেবল ৬৯ টি চালু রয়েছে।
এদিকে, অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশিরা ঘরেই সিলিন্ডার মজুত করতে শুরু করেছেন যাতে ঘরেই চিকিৎসা নেওয়া যায়। সংকটে পড়তে না হয়।
ডা. তালুকদার বলেন, ‘অনেক হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের দায়িত্বে রেখে সিনিয়র চিকিৎসকরা চলে যান। তারা কাজ করতে আসতে খুব ভয় পান।’
‘তারা (জুনিয়র চিকিৎসকগণ) জানেন না তারা কী করছেন। কোন ধরনের প্রোটোকল বা চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কোন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এ সম্পর্কে খুব কম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
গত ৮ মার্চ দেশটিতে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। এরপরই হাসপাতালগুলোকে কোভিড ও নন-কোভিড দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
ডা. পাভেল জানান, ‘কোভিড হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে অনেকেই উপসর্গের কথা লুকিয়ে নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে সাহায্যের জন্য আসেন। নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না। ফলে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে চিকিৎসক ও নার্সরা কাজ করতে অনিচ্ছা জানান।’
স্বাস্থ্যসেবা জরুরি অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ এখন গভীর মানবিক সংকটেরও মুখোমুখি। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কোভিড -১৯ এর সংক্রমণ যখন আকাশছোঁয়া তখন দেশকে উন্মুক্ত করে দেওয়া, “স্পষ্টতই অর্থনীতির পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকারের একটি মরিয়া প্রচেষ্টা”।’
দেশটির রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়, যার অধিকাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে তা এপ্রিল মাসে গত বছরের তুলনায় ৮৩ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশের ‘লকডাউন’ এর ফলে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়ে পরিবারসহ ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের জরিপ বলছে, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে দিনে তিন বার খাবার খেতে সক্ষম পরিবারের সংখ্যা যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ কমেছে।
প্রথমেই কাকে সাহায্য করা প্রয়োজন তা শনাক্ত করা এখনো একটি সমস্যা হিসেবেই থেকে গেছে। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘সরকারের সেফটি নেট প্রোগ্রামগুলো বেশিরভাগই গ্রামীণ দরিদ্রদের লক্ষ্য করে। শহরগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে লকডাউনের প্রভাব আরও তীব্র সেখানকার পরিস্থিতি এখনো অস্পষ্ট।’
সালেহ বলেন, ‘আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে হবে। আমাদের মতো দেশে প্রতিদিন কয়েক হাজার পরীক্ষা এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।’
তার মতে, পরীক্ষার বাইরেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাসিন্দাদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো।
ব্র্যাকের মতো স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্যান্য অনেক এনজিও।
এ ধরনের কয়েকটি প্রকল্পের একটি হলো ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’। এই দাতব্য সংস্থাটির বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক এবং গ্রাম উন্নয়ন দলগুলো হাত ধোওয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি করোনার উপসর্গ শনাক্ত ও কীভাবে আইসোলেশনে থাকতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে।
এছাড়াও সচেতন নাগরিকরা নিজস্ব তহবিল গঠন করে সহায়তা কর্মসূচি চালাচ্ছেন।
স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রামের সমাজসেবী আজিজুল হাকিম রমজান মাসে প্রতিদিন ৬০০ জনের জন্য রান্না করা খাবার সরবরাহ করেছেন।
স্থানীয় একজন সমাজসেবী হিসেবে তিনি ও তার পরিবার বেশ কয়েক বছর ধরেই রমজান মাসে এটি করেন। তবে এ বছর, মহামারিতে কষ্টে থাকা মানুষের জন্য তিনি যতটা সম্ভব খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘মধ্যম আয়ের পরিবার যারা সাধারণত প্রতিদিনের খাবার ব্যবস্থা করতে পারতো তারাও খাবারের জন্য লড়াই করে চলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবাইকে নিজেদের জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা ভিএসও’র এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দিনাজপুরের মোফাজ্জল হোসেন। এলাকার মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘গ্রামের মানুষ জানেন না কী চলছে। তারা করোনার কথা শুনেছে, তবে কীভাবে এটি ছড়িয়ে পড়েছে বা কীভাবে এটি বন্ধ করা যায় এটা তারা জানে না।’
তিনি বলেন, ‘এখানে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ভাবেন, করোনা কেবল শহরের ধনী লোকদের হবে। অনেকেই বলেন, এটা সৃষ্টিকর্তা মানুষের শাস্তি দিতে পাঠিয়েছেন। গ্রামের ইমামরাও অনেক সময় এই ধরনের কথা বলেন।’
সরকারি ছুটি প্রত্যাহারের পর স্থানীয় বাজারগুলোতে জনসমাগম দেখেন তিনি।
বলেন, ‘স্থানীয় বাজারে এখন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে সচেতনতার কথা বললে সবাই এখন বলছে, “করোনা পরিস্থিতি ভালো হয়ে গেছে। এই কারণেই সরকার লকডাউন প্রত্যাহার করেছে”।’
বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, ‘আচরণগত পরিবর্তনের জন্য সময় লাগে। সরকার হয়তো বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারের জন্য আইন করতে পারে। কিন্তু, মানুষ যদি সচেতন না হয়, না জানে তাহলে মাস্ক তাদের নাকের নিচেই (অনেকেই যেভাবে পরেন) রেখে দেবেন। তাহলে এটা কি ভালো ব্যবস্থা হবে? ভবিষ্যতের কী হতে যাচ্ছে এটা ভেবে আমি আতঙ্কিত।’
(দ্য টেলিগ্রাফে ১১ জুন, ২০২০ এ প্রকাশিত)
সূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার