।। আব্দুল মালেক ।।
শত প্রতিকূলতা আর অভাবকে জয় করে অদম্য মেধাবী গাজীউল হক গাজী চলতি এসএসসি(ভোক) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। ব্রহ্মপূত্র নদের ভাঙ্গনে ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারিয়ে বাবা প্রতিবন্ধি হায়দার আলী স্ত্রী ও চার সন্তানকে নিয়ে দূর্বিসহ জীবন কাটাতে থাকেন। উপার্জনহীন অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াতো দুরের কথা দু’বেলা খাবার জোটানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে তাদের। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে স্ত্রী ছোট ছেলে গাজীউল হক গাজী ও দুই মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। প্রতিবন্ধী হায়দার আলীর আশ্রয় হয় বোনের বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের ভরণ পোষন আর লেখাপড়ার খরচ যোগাতে মেজো মেয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। গার্মেন্টসে চাকুরীর স্বল্প বেতন দিয়ে ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে থাকেন। এগিয়ে আসেন আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের লোকজন। গাজীউল হক গাজী জিপিএ-৫ পাওয়াতে খুশি প্রতিবন্ধী হায়দার আলীসহ সকলেই ।
প্রতিবন্ধী হায়দার আলীর সাথে তার বোনের বাড়ি উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে দেখা করতে গেলে তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে হাসিমুখে বেড়িয়ে আসেন। ছেলের ভাল ফলাফল কেমন লেগেছে এমন প্রশ্নে উত্তরে হাসিমুখে জবাব দিলেও কষ্ট গুলো যেন তার চোখেমুখে ফুটে উঠে মহুর্তেই। চোখের পানি ছলছল হয়ে উঠে।
তিনি জানান, দুই-তিন দফায় ব্রহ্মপূত্র নদের ভাঙ্গনে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। অভাবের সাথে লড়াই করে বড় মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর কর্মহীন অবস্থায় সংসার চলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। একদিন শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে ওখানেই পাঠিয়ে দেই। মেজো মেয়ে ফেরদৌসী ছোট ভাইবোন আর সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে চাকুরী নেয়। স্ত্রী মেজো মেয়ের সাথে ঢাকা থাকা শুরু করেন। ছোট মেয়ে জেবা আনিকা ও একমাত্র পুত্র গাজীউল হক গাজী রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় ইকরচালী গ্রামে নানার বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া চালাতে থাকে। ছোটমেয়ে জেবা আনিকা রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে মাষ্টার্স শেষ করেছেন। বর্তমানে চাকুরী না হওয়ায় বেকার বসে আছেন।
ছেলে গাজীউল হক গাজী তারাগঞ্জ উপজেলার জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসিতে জিপিএ-৫, জেএসসি পরীক্ষায় একই উপজেলার ইকরচালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ ও চলতি এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় কম্পিউটার ট্রেডে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতেই তার দু’চোখ ছলছল করে উঠে। একটু থেমেই হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠেন। ছেলে ভাল ফলাফলের আনন্দ যেন মনের ভিতরে জমাট বাঁধা কষ্ট গুলো অশ্রু হয়ে বেড়িয়ে আসে। উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসে। চোখের পানি মুছতে মুছতেই বলেন, মেয়েটার চাকুরী আর ছেলেটার বাকি লেখাপড়াটা শেষ করাতে পারলে মরেও শান্তি পাব।
অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যাবে নাতো মেধাবী গাজীউল হক গাজীর লেখাপড়া? এক সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধি পিতার স্বপ্ন গুলো বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে আসবে কি কেউ? এমন পরিস্থিতিতেও মেধাবী গাজীউল স্বপ্ন পূরণে অবিচল।
এসময় স্থানীয় লোকজন জানান, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে প্রতিবন্ধি হায়দার আলী ভাসমান জীবন যাপন করেও ব্রহ্মপূত্র নদী ভাঙ্গনে সবকিছু হারিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন ভাঙ্গন কবলিত মানুষের জন্য। ক্রাচে ভর দিয়ে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়েই নদী ভাঙ্গনরোধে কাজ করে যাচ্ছেন।
কিছুদিন আগে উলিপুর প্রেসক্লাবের সামনে নিজের একটি হুইল চেয়ার অসহায় একজন প্রতিবন্ধীকে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বর্তমানে হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে বোনের বাড়িতে আশ্রিত থেকে জীবনযাপন করছেন।