।। নিউজ ডেস্ক ।।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তি থেকে প্লাজমা সংগ্রহের কার্যক্রম আজ শনিবার শুরু হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ করোনাজয়ী তিনজন চিকিৎসকের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করবে। প্রাথমিকভাবে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৪৫ জন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর ওপর আশা জাগানিয়া ‘প্লাজমা থেরাপি’ প্রয়োগ করা হবে। ‘প্লাজমা থেরাপি’ প্রয়োগের বৈজ্ঞানিক গবেষণার (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) কাজটি আগামী জুন মাসে শেষ হতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনায় আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের সুস্থ করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশে প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার শুরু হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের করোনায় আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের সারিয়ে তোলার জন্য প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে গবেষণা করার (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক এম এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য প্লাজমা থেরাপির পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক গবেষণার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আজ শনিবার থেকে তা শুরু হচ্ছে। করোনার সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা তিনজন চিকিৎসকের প্লাজমা সংগ্রহ করা হবে। প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কাজটি শেষ হতে পারে আগামী জুনে।’
করোনাজয়ী যে তিনজন চিকিৎসক প্লাজমা দিতে রাজি হয়েছেন, তাঁরা হলেন ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক দিলদার হোসেন বাদল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক পিয়াস এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আতিয়ার রহমান।
চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩ লাখ ৫ হাজার ৩৯৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মারা গেছে ২৯৮ জন। সংক্রমিত ২০ হাজার ৬৫ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে ৩ হাজার ৮৮২ জন। এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।
করোনায় ‘প্লাজমা থেরাপি’ চিকিৎসা:
মানুষের রক্তের জলীয় অংশকে বলা হয় প্লাজমা। রক্তে প্লাজমা থাকে ৫৫ ভাগ। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর যাঁরা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। করোনাজয়ী ব্যক্তির দেহে তৈরি অ্যান্টিবডি যদি করোনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন। অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে করোনাজয়ীর অ্যান্টিবডি প্রয়োগের পর অনেকে সুস্থ হয়ে ওঠায় চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। করোনাজয়ীর অ্যান্টিবডি থাকে রক্তের প্লাজমায়। সুস্থ ব্যক্তির দেহ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে তা করোনায় সংক্রমিত অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হয় বলে এই চিকিৎসাপদ্ধতির নাম হয়েছে ‘প্লাজমা থেরাপি’।
প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগে কীভাবে করোনা রোগী সুস্থ হতে পারেন, সে ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেলের হেমাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক এম এ খান বলেন, ‘প্লাজমা থেরাপি হলো শতবর্ষের পুরোনো চিকিৎসাপদ্ধতি। প্লাজমায় অনেক ধরনের অ্যান্টিবডি থাকে। যখন কেউ কোনো রোগে আক্রান্ত হন, তখন সেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর রক্তে এক ধরনের অ্যান্টিবডি প্রোটিন তৈরি হয়। ওই প্রোটিন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের চারপাশে আবরণ তৈরি করে, যা ভাইরাস-ব্যাবটেরিয়াকে অকেজো বা নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এভাবে অ্যান্টিবডি শরীরের ভেতর সক্রিয় ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম ধ্বংস করে দেয়। এটাই হলো বেসিক মেকানিজম।’
চিকিৎসকেরা জানালেন, করোনায় সংক্রমিত যাঁদের শ্বাসকষ্ট রয়েছে, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কমে গেছে, সেসব রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণত প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়।
অধ্যাপক এম এ খান বলেন ‘করোনা যাঁদের ফুসফুস একেবার নষ্ট করে ফেলেছে, যাঁদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে, এমন রোগীদের বেলায় প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগে খুব বেশি ভালো ফলাফল আসছে না বলে জানতে পেরেছি। তবে আইসিউতে নেওয়ার আগে করোনা থেরাপি প্রয়োগ করলে অল্প সময়ের ব্যবধানে রোগী সুস্থ হয়ে উঠছেন। কারণ করোনাজয়ীর অ্যান্টিবডি করোনা রোগীর শরীরে গিয়ে ভাইরাসকে অকেজো করে দেবে। ফলে ফুসফুসে তীব্র সংক্রমণ (একিউট লাং ইনজুরি) হবে না। এসব রোগীর আইসিইউতে নেওয়া লাগবে না। এমনকি ভেন্টিলেশনও দেওয়া লাগবে না। তবে এমন না যে শতভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এটা কাজ করবে। করোনার চিকিৎসায় কার্যকর উপায় না থাকায় বিশ্বে প্লাজমা থেরাপির ব্যবহার শুরু হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগে ভালো ফলাফল পেয়েছে চীন। ১০ জন করোনা রোগীর ওপর প্লাজমা থেরাপি চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহার করে প্রত্যেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সফলতা পেয়েছে ভারতও।
প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও (এফডিএ)। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য করোনাজয়ীদের কাছে প্লাজমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এফডিএর প্রতিবেদন বলছে, ‘আপনি যদি করোনাকে পরাজিত করে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি প্লাজমা দান করেন। আপনার প্লাজমায় করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি আরেকজন করোনা রোগীকে সুস্থ হতে সাহায্য করতে পারে।’
প্লাজমা সংগ্রহ বড় চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর পর থেকে দেশে করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে এ ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
করোনাজয়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক এম এ খান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা করোনাজয়ী সুস্থ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্লাজমা সংগ্রহ শুরু করব। যাঁরা প্লাজমা দেবেন, তাঁদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা নেই। অনেকে মনে করেন, প্লাজমা দিলে বোধ হয় আবার রি-ইনফেকশন হওয়ার সুযোগ থাকবে। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। সাধারণ করোনাজয়ী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ এবং সরকারি সহযোগিতা ছাড়া প্লাজমা সংগ্রহের কাজ সফল করা মোটেও সম্ভব নয়।’
করোনাজয়ী যেকোনো ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেলের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্লাজমা দিতে পারবেন।
২ মে থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে করোনা রোগীদের ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়। আজ শনিবার থেকে হাসপাতালটির মেডিসিন ব্লকে করোনার দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হবে। এই ভবনে প্রায় ৬৫০ জন করোনা রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
করোনা রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান হেমাটোলোজির অধ্যাপক এম এ খান বলেন, ‘একজন করোনাজয়ীর প্লাজমা অন্তত দুই থেকে তিনজন করোনা রোগীর দেহে প্রয়োগ করা যাবে। আগামী সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ৪৫ জন রোগীর ওপর পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হবে। আমরা এসব রোগীকে পর্যবেক্ষণ করব। আমরা তুলনা করব জ্বর কমল কি না, নিউমোনিয়ার লক্ষণ কমছে কি না, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কেমন প্রভৃতি বিষয়।’
করোনাজয়ীর প্লাজামায় অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশি থাকলে তা সংক্রমিত ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক বলে মনে করেন চিকিৎসক এম এ খান।
সূত্রঃ prothomalo