|| জাহাঙ্গীর আলম সরদার ||
বাংলাদেশে যেকোন দূর্যোগকালীন সময়ে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম থেকে চুরির ঘটনাও সবার জানা। এসময় কি তথাকথিত ত্রান চোরেরা বেশি সরব থাকেন, নাকি মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক নজরদারী একটু বেশি থাকে বলে চুরির ঘটনা সবার সামনে আসে, সেই কৌতূহল থেকেই যায়। সরকার বছরের বেশির ভাগ সময় কোন না কোনভাবে হতদরিদ্র মানুষের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তাহলে সে সময়গুলোতে ত্রাণ কিংবা অন্য কোন সহযোগিতা তছরুপের ঘটনা জন-মানুষের নজরে আসে না কেন? নাকি মিডিয়াও বিষয়গুলো ফলাও করে প্রচার করেন না। নাকি বাংলাদেশে সরকারী সাহায্য সহযোগিতা দূর্যোগকালীন সময়ে বেশি আসে বলে এমন প্রবণতার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ত্রান বিতরণে সরকারের মন্ত্রী, এমপি থেকে রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কর্মহীন মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই ত্রাণ চুরির ঘটনা সামনে চলে আসলে সরকার বিব্রত হন। এ পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ত্রান বিতরণে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার প্রতিটি জেলায় একজন করে সচিবকে ত্রান বিতরণ তদারকির দায়িত্ব প্রদান করেছেন। এখন দেখার বিষয় সচিব মহোদয়গণ কতটা নিয়ন্ত্রন করতে পারেন ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যই দুস্থ্যদের তালিকা তৈরি থেকে বিতরণ পর্যন্ত প্রশাসনিক নজরদারী বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি ত্রাণ চুরির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। আর তা না হলে সময়েই বলে দিবে সচিব মহোদয়গণ কতটা সফল হবেন। এ পরিস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মহোদয়গণের কাছেও ত্রাণ বিতরণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ চুরি ঠেকানো কিছুটা চ্যালেঞ্জও বটে।
দেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। সেই শুরু হয়ে গত ৩ মে পর্যন্ত এই মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয় মোট ১৭৭ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ৯ হাজার ৪শত ৫৫ জন। ক্রমেই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে লাগামহীনভাবে। মানুষকে সচেতন করতে সরকার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারীরা নিরন্তর ছুটে চলছেন শহর থেকে গ্রামে। কিন্তু আমরা কতটা সচেতন হতে পারছি!
পবিত্র রমজান মাস। সিয়াম সাধনার এ মাসে আমরা কতটা নিরাপদ থাকতে পারবো, সেটাও দেখার বিষয়। তাছাড়া দেশে বর্তমানে অধিকাংশ মানুষেই কর্মহীন। এ কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দীর্ঘসময়ে কর্মহীন নিম্নআয়ের মানুষ খাদ্যসংকটে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। খাদ্যসংকটে থাকা এসব মানুষের জন্য সরকারীভাবে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তাতে কতটুকু সম্ভব তা বলা যাচ্ছে না। আর এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও। সরকার এসব মানুষের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীভিত্তিক তালিকা তৈরি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব তালিকার বাইরে থাকছেন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় থাকা বিপুল পরিমান মানুষ। যাদের নাম বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন উপকারভোগীর তালিকায় আছে, সেইসব মানুষ এ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে পারছেন না। তাহলে এসব মানুষ খাদ্য সহায়তা পাবে কিভাবে? যারা বয়স্ক কিংবা অন্য কোন ভাতাভোগী, তারা প্রতি তিন মাস পরপর এসব ভাতা পেয়ে থাকেন। তাহলে এ দূর্যোগ মহুর্তে তাদের খাদ্য সহায়তার কি হবে? এসব উপকারভোগী মানুষও তো খাদ্য সংকটে থাকবেন এটাই বাস্তবতা। হতদরিদ্র পরিবারের বয়স্ক কিংবা বিধবাদের অথবা হতদরিদ্র পরিবারের লোকজনই সরকারের নেয়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীর তালিকায় আছেন। এসব মানুষকেও খাদ্য সহায়তার আওতায় আনতে হবে। সময় এসেছে বিভিন্ন দূর্যোগকালীন সময়ে সারাদেশে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার মতো মানুষগুলোর জন্য একটি স্থায়ী ডাটাবেজ তৈরি করা। তাহলে যেকোন দূর্যোগকালীন সময়ে সে ডাটাবেজ ধরে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা যাবে। যদি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে সরকারী সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে দূর্নীতি কিংবা প্রকৃত উপকারভোগী বাদ পরার সম্ভাবনাও কম থাকবে। তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তিতে জনপ্রতিনিধিদের আর্থিক লাভবান হওয়ার সুযোগ কমে যাবে। তবে দূর্যোগকালীন সময়ে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। শুধু সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তা শতভাগ সফল করাও সম্ভব। তবে এখনই সময় যারা ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার যোগ্য, তাদের আলাদা তালিকা করা। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষের পৃথক তালিকা করে দূর্যোগকালীন সময়ের জন্য তাদের রেশনিং ব্যবস্থা করা।
দূর্যোগকালীন সময়ে ত্রাণ চুরি কিংবা কালোবাজারে বিক্রি করার একটা মহোৎসব চলে এক শ্রেনীর জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ীদের মাঝে। ত্রাণ আত্মসাতের বিষয়টি শুধুমাত্র এখন হচ্ছে তা কিন্তু নয়। এ অসাধু চক্রটি দূর্যোগকালীন বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ চুরির মহোৎসবে মেতে উঠেন। আর বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক জনপ্রতিনিধিরা দূর্যোগকালীন সময়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠেন ত্রান আত্মসাতে। স্থানীয় প্রশাসন ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে থাকলেও মূলত তালিকা তৈরি থেকে বিতরণ করে থাকেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ সময়ে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে তদারকি করা সম্ভব হয়ে উঠে না। আর এ সুযোগ নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা তালিকা তৈরি থেকে বিতরণে দূর্নীতি করার সুযোগ পান। যদি ধরে নেয়া যায়, একজন ব্যবসায়ীর ঘরে ত্রাণের চাল পাওয়া গেল? তাহলে প্রশাসন তাৎক্ষনিক ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। কিন্তু ওই ব্যবসায়ীর ঘরেতো এমনি এমনি ত্রানের চাল যায়নি। কোন কোন জনপ্রতিনিধি কিংবা ত্রাণ বিতরণের সাথে জড়িত কোন ব্যক্তি ওই ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন। যদি সঠিক তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি কিংবা ত্রাণ বিতরণের সাথে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে চুরি কিছুটা ঠেকানো যেতে পারতো।
স্থানীয় পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সৎ যোগ্য বক্তিরা অংশ নিতে চান না। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনেক আর্থিক লেনদেনের প্রশ্ন আসে, দলীয় মনোনয়ন থেকে নির্বাচন পর্যন্ত। বিশাল অংকের টাকা খরচ করে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন পন্থায় তা তোলার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি থেকে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্লোভ থেকে সততার সাথে কাজ করতে হবে। দূর্যোগকালীন সময়ে ত্রাণ সহায়তার সাথে জড়িতদের অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রকৃত অভাবগ্রস্থ মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণকেও সজাগ হতে হবে। দূর্যোগের সময় জনপ্রতিনিধিদের কাছে যেমন জনগনের প্রত্যাশা আছে, তেমনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময়ও আপনাদেরকে একজন সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে যখন আপনি একজন অযোগ্য ও অসৎ প্রার্থীকে কোন ভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নির্বাচিত করবেন, তখন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধির কাছে আপনার সঠিক প্রাপ্ত্যতা বা সেবা পাওয়াও সম্ভব হবে না। তাই সকল পক্ষকেই দায়িত্বশীল নাগরিকের মতো কাজ করতে হবে। তবেই সম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রাণ বিতরণে অনিয়মে জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছেন। আসুন সকলে মিলে করোনাভাইরাসের এ ক্রান্তিকালে নির্লোভ থেকে সততার সাথে অভাবগ্রস্থ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই। দেশের এ দূর্যোগ কেটে যাবেই। উঠবেই নতুন সূর্য।
লেখকঃ জাহাঙ্গীর আলম সরদার, সাংবাদিক ও সহকারী অধ্যাপক, উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল এন্ড কলেজ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম।
(বিঃদ্রঃ প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।)