|| জাহাঙ্গীর আলম সরদার ||
সারা বিশ্ব আজ স্তম্ভিত। নিয়ন্ত্রনহীনভাবে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ মরণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ এ ভাইরাসের কারনে মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিষেধকবিহীন এ ভাইরাসকে প্রতিরোধের একমাত্র উপায় মানুষের সচেতনতা। কিন্তু আমরা কতটুকু সচেতন? এই ভাইরাস থেকে সচেতন হতে সরকার সারাদেশে জনগনকে সচেতন করতে নানামুখী উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কতটুকু সফল হব তা সময়ই বলে দিতে পারবে। তবুও আমরা করোনামুক্ত থাকতে নিজেদের থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের উন্নত রাষ্টগুলো আজ করোনামুক্ত থাকতে তাদের জনগনকে সচেতন করার নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও মৃত্যুর মিছিল যেন কোনোভাবেই থামছে না। ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়ন্ত্রনহীনভাবে। কবে থামবে তাও অনিশ্চিত। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেনি। তবে আপাতত সচেতনতাই একমাত্র প্রতিষেধক।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বর্তমান সময়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতাদের মাঠে না পাওয়া গেলেও জীবনবাজি রেখে মাঠে আছেন চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মাঠে আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। সাংবাদিকসহ সামাজিক ও কিছু মানবিক সংগঠনের কর্মীরা অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন অনেকেই। সরকার বর্তমানে কর্মহীন অসহায় মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। কিন্তু যে সকল এনজিও গ্রামের গরীর মানুষের আত্মসামাজিক উন্নয়নের কথা বলে কাজ করছিলেন, আজ সে সকল এনজিও কোথায়? এ দূর্যোগে মানুষের পাশে না দাড়িয়ে কোথায় আছেন? কোথায় রাজনৈতিক দলের সেই ডাকসাইডের নেতারা? মানুষের কল্যানের জন্য তাদের তো মাঠে দেখা যাচ্ছে না। সুশীল সমাজের সেই সব বুদ্ধিজীবিদের তো সরব হতে দেখা যাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ যদি আক্রান্ত হতো এ করোনাভাইরাসে, তাহলে অনেক বিত্তশালী, রাজনৈতিক নেতা ও তথাকথিত সুশীলরাসহ অনেক ব্যবসায়ী আশ্রয় নিতেন বিশ্বের উন্নত রাষ্টগুলোতে। কিন্ত বিধি বাম! পৃথিবীর উন্নত রাষ্টগুলো আরো বেশি বিপদজনক হয়ে উঠেছে। বাধ্য হয়েই তারা বাংলাদেশে আছেন। করোনাভাইরাস শুধু যে গরীব মানুষের রোগ তা কিন্তু নয়। আপনি যত ক্ষমতাধর আর সম্পদশালীই হউন না কেন এ ভাইরাস সবার জন্যই আতংক। বেঁচে থাকলে আপনার অর্থসম্পদ কমবে না বরং বাড়বে। তাই সকলের উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
আমি উপজেলা শহরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করি। সঙ্গত কারনে গ্রামের হতদরিদ্র ও শ্রমজীবি মানুষের দূর্বিসহ জীবনযাপনের কথাগুলো আমি কাছ থেকে জানি। অনেকেই নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারী সহযোগিতা এখন পর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গ্রামের হাজার হাজার মানুষ দূর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এসব মানুষের অভাব অনুযোগের বিষয়গুলো জানার সুযোগ হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দূর্যোগ মোকাবেলায় প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঘোষনা করেছেন। তবে একজন মানুষের পক্ষে তো সবকিছু করা সম্ভব নয়। এ দূর্যোগ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্লোভ থেকে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যানে কাজ করতে হবে। কিছু দুষ্টু মানুষের কারণে ভাল উদ্যোগগুলোও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোন দলীয় মোড়কে যেন ছাড় না পান, তাহলে হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে সময় এসেছে নিজেকে বদলানোর।
ইতোমধ্যে ত্রাণ চুরির ঘটনায় অনেকটা বিব্রত সরকার। সরকার ত্রাণ বিতরণে অনিময় ঠেকাতে প্রতি জেলায় রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের পরিবর্তে সচিবদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মহোদয়গণ কতটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন। প্রশাসনের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জও বটে।
গত ৯ এপ্রিল কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা ভূমি অফিসের ফেসবুক পেজে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির স্টিভ একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘আজ সকালে আব্বার সাথে মোবাইলে কথা বলার সময় আব্বাকে বললাম যে মুক্তিযুদ্ধ করিনি কিন্তু এখন একটি যুদ্ধ করছি, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। আব্বা বললেন এই যুদ্ধটিও বড় যুদ্ধ, কারণ আমরা যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি সে এক অদৃশ্য শক্তি। কথাটি শুনে মন ভরে উঠল, কারন মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি বলে আক্ষেপ ছিল, কারন তখন আমার জন্ম হয়নি। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল’। তাঁর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলতে চাই প্রত্যেক ঘরে ঘরে নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে তোল। উল্লেখ্য যে আমার আব্বাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সকল মুক্তিযোদ্ধার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার লিখাটিতে আঘাত পেয়ে থাকলে। আপনাদের অবদান অতুলনীয়’।
উপজেলায় পর্যায়ের একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি যতটুকু দেখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করোনা মোকাবেলায় মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছেন। যেখানেই খবর পাচ্ছেন, দ্রুত পুলিশ বাহিনী নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। বিষয়টি প্রশংসার জন্য বলছি না। একজন সাধারণ মানুষের যেমন করোনার ঝুকি আছে, তেমনি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই ঝুকি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা জীবনের ঝুকি নিয়ে আমাদের জীবন বাঁচাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কতটা সচেতন হচ্ছি। অনেকে বলবেন, ওনারা চাকুরী করেন, ওনাদের এটা কাজ। প্রতিটি মানুষের মতো ওনারাও কোন না কোন পরিবারের সদস্য। সবার বাঁচার অধিকার আছে।
সরকারের কাছে আমার কয়েকটি প্রস্তাবনা হলো – করোনা চিকিৎসা কাজে সরাসরি নিয়োজিত সকল চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকা করা দরকার। ঢালাওভাবে না দিয়ে বিশেষ করে প্রশাসনের যেসকল কর্মকর্তা দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করছেন, সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে সকল পুলিশ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আছেন তাদের আলাদা তালিকা করে আগামীতে চাকুরী ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা কিংবা ইনক্রিমেন্ট প্রদান করুন। এর ফলে ভবিষ্যতে যেকোন দূর্যোগ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সকলেই কাজে উৎসাহিত হবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেভাবে গ্রাম পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। সময় এসেছে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের চাকুরী সরকারীকরণ করার। তাহলে গ্রাম পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা আরো বেশি সহজ হবে। নিভৃত গ্রামগুলোর আইনশৃঙ্খলা অনেকটাই সুরক্ষিত হবে। আর অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের তালিকা করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিরা রাজনীতি করতে উৎসাহিত হন। সময় এসেছে রাজনৈতিক দলে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি ও দুষ্টু চক্রের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার।
ঘরে থাকি, নিজে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি, সবাই সুস্থ থাকি। একদিন বিশ্বব্যাপী এ মহামারী দূর হবেই। সারা বিশ্বের মতো আমরাও ঘুরে দাঁড়াবো।
লেখকঃ জাহাঙ্গীর আলম সরদার, সাংবাদিক ও সহকারী অধ্যাপক, উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল এন্ড কলেজ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম।
(বিঃদ্রঃ প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।)