|| আতিকুর রহমান ||
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ উদ্বোধনের সময় এর প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস বলেছিলেন, “যে সেতু নির্মাণ করে দিয়ে গেলাম, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ সেতু চিরযৌবনা হয়ে থাকবে।”। আজ গেইল নেই, নেই লর্ড হার্ডিঞ্জ। কিন্তু রয়ে গেছে তাদের অমর কীর্তি। বিশাল ও অপরূপ সৌন্দর্যপূর্ণ চিরযৌবনা এ সেতু আজও সাক্ষ্য দেয়, গেইল সত্য বলেছিলেন। এ মাসে ১০৫ বছরে পা দিয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এ যেন দু’টি শতাব্দীকে সংযোগকারী এক সেতু। যেখানে সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। যে ব্রিজ পার হয়ে আমরা ফিরে যাই শত বর্ষ আগে। এ যেন বর্তমানের বুকে একখণ্ড হারিয়ে যাওয়া অতীত।
রেলওয়ে পাকশী বিভাগের সেতু প্রকৌশলীর কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা ‘দ্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ওভার দ্য লোয়ার গাঙ্গেজ অ্যাট সাঁড়া’ বই থেকে জানা যায়, বিগত ১৮৮৯ সালে সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। ১৯০২ সালে স্যার এফ জে ই স্প্রিং সেতুর ওপর একটি বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তুত করেন। সেতুটির স্থান নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ১৯০৮ সালে রেলওয়ের প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলসকে হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের জন্য প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক পাঁচ বছর কাজ করে ১৯১৫ সালে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে। সেতু নির্মাণে সেই সময়ে ব্যয় হয় চার কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় রুপি। ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে বড় অর্জন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। স্বাধীনতার জন্য মানুষকে অনেক বড় অর্জন ও বিসর্জন দিতে হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মিত্র বাহিনী এ ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করে। বিজয়ের শেষ লগ্নে (১১ ডিসেম্বর) আহত হয় ‘হার্ডিঞ্জ’। বোমার আঘাতে ১২ নম্বর মূল গার্ডারটি ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া ২, ৯ ও ১৫ নম্বর গার্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে সময়।
ব্রিটিশ সরকার নিজ খরচে জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকো দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যানের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। ভারত ১২ নম্বর গার্ডারের অনুরূপ আরেকটি স্প্যান পুন:স্থাপন করে। ব্রিজের ১২ নম্বর গার্ডে আজো লেখা আছে সে তথ্য। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এ সেতু। ‘হার্ডিঞ্জ’ যেন এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর শত বছরের গৌরব নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছ মাথা উঁচু করে। হার্ডিঞ্জ যেন গেইলের শত বর্ষ পরের প্রজন্মের জন্য ভালোবাসার এক মহান উপহার। শত অনুরাগ ও আনন্দ অভিবাদন দিয়ে গড়া এক প্রজন্ম সেতু।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একটি ইতিহাস। শুধু পাবনা বা কুষ্টিয়া নয়, গোটা বাংলাদেশের গৌরব আর অহংকারের প্রতিক হিসেবে আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শৈল্পিক কারুকাজের দৃষ্টিনন্দন ও ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করছি ব্রিজের সেই সব কারিগরদের।
লেখকঃ আতিকুর রহমান, রেল গবেষক
সূত্রঃ রেলনিউজ বিডি