।। নিউজ ডেস্ক ।।
কোয়ারেন্টিন মানে সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তির চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করা। কোয়ারেন্টিন তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য, যাঁরা রোগে আক্রান্ত হননি কিন্তু রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, রোগের প্রাদুর্ভাবযুক্ত এলাকায় থেকেছেন, অর্থাৎ যাঁরা রোগ ছড়াতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
কথাটা এসেছে ‘কোয়ারান্টাগাইরন’ থেকে, যার অর্থ ফরটি ডে (৪০ দিন)। প্লেগের সময় জাহাজের মাল খালাস করার আগে ৪০ দিন তীরে ভিড়ে থাকতে হতো। সম্প্রতি চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের কারণে কোয়ারেন্টিনের আগে কুষ্ঠ রোগ, পীতজ্বর বা ইয়েলো ফিভার, কলেরার মতো রোগের বিস্তার ঠেকানোর জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ের ইবোলাও এর একটা উদাহরণ।
কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন এই দুটি বিষয় আমাদের কাছে একই রকম মনে হলেও এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। রোগ ছড়ানোর ভয়ে রোগীকে যখন আলাদা রাখা হয়, সেটা প্রোটেক্টিভ সিকোয়েস্ট্রশন (রিভার্স কোয়ারেন্টিন)। আক্রান্ত রোগীকে আলাদা ব্যবস্থায় রেখে চিকিৎসা করাকে বলে আইসোলেশন।
কত দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে?
এটা নির্ভর করবে ওই রোগের ইনকিবেশন পিরিয়ড বা জীবাণু প্রবেশ থেকে রোগ প্রকাশিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময় কত দিন, তার ওপর। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ ১৪ দিন ধরা হয়েছে।
কোয়ারেন্টিনের প্রতীক
কুইবেক অর্থ ইয়েলো বা হলুদ। হলুদ রঙের পতাকা তাই একসময় কোয়ারেন্টিন বোঝাত। সবুজ, কালো বা হলুদ-কালোর সংমিশ্রণ কোয়ারেন্টিন বোঝাতে সবই ব্যবহার হয়েছে ইতিহাসে। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য হলুদ পতাকার অর্থ বোঝায় জাহাজ সংক্রমণমুক্ত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উপযোগী।
কোয়ারেন্টিনের নীতিমালা
টাইফয়েড মেরির ২৭ বছরের কোয়ারেন্টিনের ঘটনা মানবাধিকারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে ব্যক্তির কিছু অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। ১৯৮৪ সালের জাতিসংঘ স্বীকৃত সিরাকুসা নীতিমালা অনুসারে কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতাগুলো হলো:
১. যারা থাকবে, তাদের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসা, রোগ প্রতিরোধের সব ব্যবস্থা করতে হবে।
২. প্রিয়জন ও পরিচর্যাকারীর সঙ্গে যোগাযোগের পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতে হবে।
৩. কর্মস্থল, চাকরি, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. সামাজিক মর্যাদা যা–ই হোক, যোগাযোগ, চলাফেরার সীমাবদ্ধতা সবার জন্য সমান হতে হবে।
৫. কোয়ারেন্টিন সমাজ ও জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হতে হবে।
৬. একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে (যেমন রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ) এটা করতে হবে।
হোম কোয়ারেন্টিন কী?
হোম কোয়ারেন্টিন মানে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে থাকবেন এবং এ সময় নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।
করোনাভাইরাসের কারণে কারা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন?
যেসব দেশে কোভিড-১৯–এর স্থানীয় সংক্রমণ ঘটেছে, সেসব দেশ থেকে যেসব যাত্রী এসেছেন এবং আসবেন (দেশি-বিদেশি যেকোনো নাগরিক), যাঁরা দেশে শনাক্তকৃত ৩ জন কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন এবং যার অথবা যাঁদের কোনো শারীরিক উপসর্গ নেই, তাঁদের ১৪ দিন স্বেচ্ছা/গৃহ কোয়ারেন্টিন পালন করতে হবে।
করোনাভাইরাসের জন্য কীভাবে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন?
হোম কোয়ারেন্টিন মানে শুধু বাড়িতে থাকা নয়। তার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধও পালন করতে হবে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে।
১. বাড়ির অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকুন।
২. আলো–বাতাসের সুব্যবস্থাসম্পন্ন আলাদা ঘরে থাকুন। সম্ভব না হলে অন্যদের থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরে থাকুন। রাতে পৃথক বিছানা ব্যবহার করুন।
৩. আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট ব্যবহার করুন। সম্ভব না হলে অন্যদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়—এমন স্থানের সংখ্যা কমান এবং ওই স্থানগুলোতে জানালা খুলে রেখে পর্যাপ্ত আলো–বাতাসের ব্যবস্থা করুন।
৪. স্তন্যদায়ী মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। তবে শিশুর কাছে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করুন এবং ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
৫. বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই ঘরে অবস্থান করলে, বিশেষ করে ১ মিটারের মধ্যে আসার প্রয়োজন হলে, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করুন।
৬. কাশি, সর্দি, বমি ইত্যাদির সংস্পর্শে এলে সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক খুলে ফেলুন এবং নতুন মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক ব্যবহারের পর ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলুন এবং সাবান–পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন।
৭. সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে। প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮. সাবান-পানি ব্যবহারের পর টিস্যু দিয়ে হাত শুকনো করে ফেলুন। টিস্যু না থাকলে শুধু হাত মোছার জন্য নির্দিষ্ট তোয়ালে/গামছা ব্যবহার করুন এবং ভিজে গেলে বদলে ফেলুন।
৯. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করবেন না।
১০. কাশি শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি–কাশির সময় টিস্যু পেপার/মেডিকেল মাস্ক/কাপড়ের মাস্ক/বাহুর ভাঁজে মুখ ও নাক ঢেকে রাখুন এবং ওপরের নিয়মানুযায়ী হাত পরিষ্কার করুন।
১১. ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। আপনার খাওয়ার বাসনপত্র—থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি, তোয়ালে, বিছানার চাদর অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করবেন না। এসব জিনিসপত্র ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফেলুন।
কখন আপনার কোয়ারেন্টিন শেষ হবে?
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার কোয়ারেন্টিন শেষ হবে। একজন থেকে অন্যজনের কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা আলাদা হতে পারে। তবে সাধারণত এ সময়সীমা ১৪ দিন।
কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে কী কী করা যাবে?
কোয়ারেন্টিনের অবসর সময়কে কাজে লাগান। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), সিডিসি এবং আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে সঠিক তথ্য পাবেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ফোন/মোবাইল/ইন্টারনেটের সাহায্যে যোগাযোগ রাখুন। দৈনন্দিন রুটিন, যেমন: খাওয়া, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি মেনে চলুন। সম্ভব হলে বাড়িতে বসে অনলাইনে বা ফোনে অফিসের কাজ করতে থাকুন। বইপড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা অথবা ওপরের নিয়মগুলোর পরিপন্থী নয়, এমন যেকোনো বিনোদনমূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করুন বা ব্যস্ত রাখুন।
পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্দেশাবলি
বর্তমানে সুস্থ আছেন এবং যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি রোগে (যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, অ্যাজমা প্রভৃতি) ভুগছেন না, এমন একজন ব্যক্তি পরিচর্যাকারী হিসেবে নিয়োজিত হতে পারেন। তিনি ওই ঘরে বা পাশের ঘরে থাকবেন, অবস্থান বদল করবেন না। কোয়ারেন্টিনে আছেন—এমন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো অতিথিকে দেখা করতে দেবেন না। পরিবারের মানুষ যে কাজগুলো করবেন:
১. কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা তার ঘরে ঢুকলে হাত পরিষ্কার করবেন সাবান–পানি দিয়ে।
২. খাবার তৈরির আগে ও পরে, খাওয়ার আগে, টয়লেট ব্যবহারের পরে হাত পরিষ্কার করবেন।
৩. গ্লাভস পরার আগে ও খোলার পরে হাত পরিষ্কার করবেন।
৪. যখনই হাত দেখে নোংরা মনে হবে, তখনই হাত পরিষ্কার করবেন।
৫. খালি হাতে কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির ঘরের কোনো কিছু স্পর্শ করবেন না।
৬. কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তির ব্যবহৃত বা তাঁর পরিচর্যায় ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস, টিস্যু ইত্যাদি অথবা অন্য আবর্জনা ওই রুমে রাখা ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে রাখুন। এসব আবর্জনা উন্মুক্ত স্থানে না ফেলে পুড়িয়ে ফেলুন।
৭. ঘরের মেঝে, আসবাবের সব পৃষ্ঠতল, টয়লেট ও বাথরুম প্রতিদিন অন্তত একবার পরিষ্কার করুন। পরিষ্কারের জন্য ১ লিটার পানির মধ্যে ২০ গ্রাম (২ টেবিল চামচ পরিমাণ) ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করুন ও ওই দ্রবণ দিয়ে সব স্থান ভালোভাবে মুছে ফেলুন। তৈরিকৃত দ্রবণ সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।
৮. কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিকে নিজের কাপড়, বিছানার চাদর, তোয়ালে ইত্যাদি গুঁড়া সাবান বা কাপড় কাচা সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে বলুন এবং ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ফেলুন। নোংরা কাপড় একটি লন্ড্রি ব্যাগে আলাদা রাখুন। মলমূত্র বা নোংরা লাগা কাপড় ঝাঁকাবেন না এবং নিজের শরীর বা কাপড়ে যেন না লাগে, তা খেয়াল রাখবেন।
৯. যদি কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ দেখা দেয় (জ্বর, কাশি, সর্দি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি), তবে দ্রুত আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করুন।
লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সাবেক অধ্যাপক, বারডেম হাসপাতাল
সূত্রঃ prothomalo